তারপর লড়াই শুরু হলো। প্রায় সম্মুখ সমর। এক অসম লড়াই। যার মধ্যে ঝলকিত হচ্ছিল ঈমাণদীপ্ত কারিশমা। কর্নেল হক নেওয়াজ কিয়ানী শহীদ এ লড়াইয়ের নেতৃত্ব দেন। তিনি প্রমাণ করে দেন পবিত্র কুরআনের প্রতি পূর্ণ ঈমান থাকলে ঈমানের দৃঢ়তায় অনড় থাকলে সূরা আনফালের ভাষ্যমতে দুইশ কাফেরের ওপর বিশজন ঈমানদার বিজয় লাভ করতে পারে।
কর্নেল হক কিয়ানী এমনিতেই মর্দে মুমিন শব্দের বাস্তব প্রতিচ্ছবি ছিলেন। সত্যিকার অর্থে আল্লাহর সৈনিক ছিলেন। তার প্রকৃত অস্ত্র ছিলো পবিত্র কুরআন। পবিত্র কুরআনের সু-সংবাদের ওপর অবিমিশ্র বিশ্বাস পোষণ করতেন তিনি। লিপা উপত্যকায় হাজার হাজার ফিট উচ্চতার চেয়ে তার আবেগ, চেতনা, বিশ্বাস ও ব্যক্তিত্ব আরো উচ্চতর ছিলো। কাশ্মীর স্বাধীনতার আকাংখা তার রক্তের অণু পরমাণুতে মিশে গিয়েছিলো। তিনি প্রায়ই লিপা বা কিয়ান উপত্যকার সুউচ্চ চূড়া দেখিয়ে তার অফিসারদেরকে বলতেন।
বেটা! যদি আমরা এই পাহাড় জয় করতে পারি তাহলে দৃষ্টি সীমা পর্যন্ত আদিগন্তের সেই পাহাড় প্রণালি আমাদের পদতলে চলে আসবে। তখন খুব সহজেই আমরা পরাধীন কাশ্মীরের কমান্ডো অভিযান পরিচালনা করতে পারবো।
তিনি নতুন অফিসারদেরকে এই বলে উৎসাহিত করতেন, বেটা! সবসময় এই চিন্তা ও পরিকল্পনা এবং জিজ্ঞাসা যেন তোমাদের মস্তিষ্কে সচল থাকে যে, শ্রী নগর জয় করতে তোমরা কোন পথ অবলম্বন করবে?
এভাবে তিনি নওজোয়ান অফিসারদের মন-মানসে পরাধীন কাশ্মীরকে স্বাধীন করার সংকল্প গেঁথে দিতেন। ১৯৬৫ এর যুদ্ধে শত্রুর দখলকৃত কাশ্মীরের দূর দূরান্ত পর্যন্ত অনেক কমান্ডো অপারেশনের নেতৃত্ব দেন এবং অবিশ্বাস্য বীরত্ব প্রদর্শন করে শত্রু পক্ষের কোমর ভেঙ্গে দেন। যার প্রতিদানে তিনি লাভ করেন বীরশ্রেষ্ঠ পদক।
লিপা উপত্যকায় সে রাতের হামলা সম্পর্কে তার ঐটা জানা ছিলো, সাধারণ রণকৌশল অবলম্বন করে হামলা চালালো কোন কাজ হবে না। কারণ, এ অবস্থায় হামলা করতে হলে অতিরিক্ত দু পাটুন সৈন্য ও পুরো তোপখানা রেজিমেন্ট নিয়ে হামলা করা উচিত। না হয় বীরুওয়ালী নাড় ক্যাম্প ও পুরো উপত্যকা শত্রুপক্ষের দয়ার ওপর ছেড়ে দিতে হবে।
কিন্তু কর্নেল হক কিয়ানী প্রতিটি পদক্ষেপে চরম দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিচ্ছিলেন। তিনি তার অফিসারদেরকে যুদ্ধের কলাকৌশল সম্পর্কিত দিক নির্দেশনা দিয়ে দিলেও জানতেন, এ লড়াইয়ে শেষভাগে জয়ের সম্ভাবনা একমাত্র শত্রু পক্ষের। কারণ তার দলের সৈন্য সংখ্যা যেমন কম তেমনি অস্ত্রশস্ত্রও অতি নগণ্য। অধিকন্তু, তাদের কাছে গরম পোষাকও নেই। খাকি উড়িই তাদের শীত নিবারক বস্ত্র। তার ওপর সেনা সাহায্য পৌঁছারও কোন ব্যবস্থা এ অবস্থায় অন্তত নেই।
এজন্য জোয়ানদের মধ্যে ঈমানের উত্তপ্ত মশাল জ্বালিয়ে দেয়া জরুরী ছিলো। কর্নেল কিয়ানী অফিসার ও জোয়ানদের উপত্যকার এক জায়গায় দাঁড় করালেন। তারপর তাদের উদ্দেশ্যে ঈমান– তাজা কণ্ঠে বললেন,
ছেলেরা আমার! আজ রাতে তোমাদেরকে যে পরিস্থিতির সম্মুখীন করা হচ্ছে সে পরিস্থিতির সম্মুখীন তোমরা আর কখনো হওনি। তোমরা এতদিন যেভাবে লড়াই করেছে এ লড়াই সে রকম নয়। আজ তোমরা সে দশমনের ওপর হামলা করতে যাচ্ছে যে দুশমনের শক্তি তোমাদের চেয়ে অনেক বেশি। ওরা পাহাড়ের ওপর মোর্চাবদ্ধ– সুরক্ষিত অবস্থায় আছে। আজ তোমাদেরকে সে লড়াই লড়তে হবে ইসলামের সূচনা লগ্নের মুজাহিদরা যে লড়াই লড়ে পৃথিবীতে অমর হয়ে আছেন। তোমাদেরকে আজ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাল্লামের স্বর্গীয় স্মৃতিকে তাজা করে তুলতে হবে। বিধর্মীরা আজ তোমাদের আত্মমর্যাদাকে চেলেঞ্জ করেছে। আজ রাতে তোমাদের বিজয় রা. শাহাদাত। জাতি আজ তোমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
তারপর কর্নেল কিয়ানী সবার উদ্দেশ্যে বললেন আল্লাহর সিপাহীরা! মাথায় কাফনের কাপর বেঁধে লড়াই করো। একথা বলে তিনি পাতলুনের পকেট থেকে একটি সাদা কাপড় বের করে সেটা মাথায় বাঁধলেন। তারপর বললেন,
দেখে নাও সবাই, এটা আমার কাফনের কাপড়ের ওপরের অংশ। আমি এটা মাথায় বেঁধে নিলাম।
কর্নেল কিয়ানী নিজের কাছে সবসময় কাফনের কাপড় রাখতেন। এর ওপর সুগন্ধি লাগিয়ে রাখতেন। কর্নেলের কথা শেষ হতেই এ হামলার অন্যতম কমান্ডার মেজর মুহাম্মদ সাবির খান এক ঝটকায় দাঁড়িয়ে গেলেন। পকেট থেকে রুমাল বের করলেন। তারপর সেটা মাথায় বেঁধে ফেললেন। বললেন,
আমার কাছে কাফনের কাপড় নেই। আজ রুমালকেই আমি কাফনের কাপড় মনে করছি।
এদৃশ্য জোয়ানদের মধ্যে যেন অগ্নি শেলের উন্মত্ততা সৃষ্টি করলো। তারা আর এখন আর কোন সেনাবাহিনীর জোয়ান নয়। আল্লাহর জোতির্ময় জানবার্য সৈনিক।
আমি লিপা উপত্যকার সে জায়গা দেখে এসেছি যেখানে কর্নেল কিয়ানী তার জোয়ানদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছিলেন। তখনকার মুক্তিকামী কয়েকজন জোয়ানের সঙ্গে পরে আমার সাক্ষাৎ হয়।
কর্নেল কিয়ানী মাথায় কাফনের কাপড় বাঁধার সময় তাদের কি অনুভূতি হয়েছিলো সেটা জিজ্ঞেস করেছিলাম। এ প্রশ্ন শোনার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি জোয়ানের চেহারা আবেগে উজ্জ্বল হয়ে উঠে। তারা বলেন।
যখন আমাদের কর্নেল ও কোম্পানি কমান্ডার মাথায় কাফনের কাপড় বাঁধলেন তখন আমাদের মধ্যে এক অজানা শক্তির বিচ্ছুরণ ঘটলো। আমরা একেবারেই ভুলে গেলাম দুশমনের শক্তি কয়েক গুণ বেশি এবং ওরা দশ হাজার ফিট উচ্চতার দারুণ সুবিধায় রয়েছে। আমাদের মনে হচ্ছিল দুশমন আমাদের পদতলে লুটিয়ে পড়েছে।