দুজনে তখনই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিলো। তারা দুই যোদ্ধা বহু বছরের পুরনো রাইফেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। যেগুলো তারা কোন কালে শখের বশে কিনেছিলো। তিনটি চামড়ার বেল্ট ছিলো তাদের কাছে। তিনটি চামড়ার বেল্টে তারা দেড়শ রাইন্ড গুলি ভরে নিলো।
যুদ্ধের মাঠে অস্ত্র ছাড়াও আরেকটা জিনিসের প্রয়োজন হয়। সেটা হলো নিজ দেশের পতাকা। কাপড়ের টেবিলক্লথ নিয়ে তারা স্বহস্তে তারকাযুক্ত পতাকা বানিয়ে নিলো। সেটা বেঁধে নিলো একটা বাঁশের আগায়। ব্যস, ঝাণ্ডা তৈরী হয়ে গেলো। গুল মুহাম্মদ যে বাক্সে করে আইসক্রিম বিক্রি করতো সেটা বহনের জন্য একটা ঘোড়ার গাড়ি তৈরী করেছিলো সে। বাচ্চারা সে গাড়ি দেখলেই কিকার করে উঠতো খুশিতে। গুল মুহাম্মদের আইসক্রিম নিউ সাউথ ভিলেজে বেশ জনপ্রিয় ছিলো। সেই ঘোড়ার গাড়িতে করে গুল মুহাম্মদ ও মোল্লা আব্দুল্লাহ বেরিয়ে পড়লো।
যুদ্ধের ময়দানের জন্য যে জায়গাটা নির্বাচন করলে সেটা ছিলো শহর থেকে দুই মাইল দূরে। এলাকাটি গম্বুজ আকারের টিলা টক্করে ছাওয়া। সেখানে এই দুই তুর্কির প্রতিনিধিত্বকারী যোদ্ধা নিজেদের মোর্চা স্থাপন করলো। জায়গাটি এ্যম্বুশের জন্য চমৎকার। কাছ দিয়ে একটি ব্রিটিশ অস্ট্রেলিয়া ট্রান্সশিপমেন্ট পরিচালিত রেললাইন চলে গেছে নিউ সাউথ ভিলেজের দিকে। একটু পরেই এখান দিয়ে একটি মেইল ট্রেন যাবে। তাতে অনেক ব্রিটিশ ইংরেজ থাকবে।
***
গুল মুহাম্মদ ও মোল্লা আব্দুল্লাহ শর্কর আগমনের অপেক্ষায় সময় কাটাতে লাগলো। আধ ঘন্টা পর হুইসেল বাজিয়ে একটি মেইন ট্রেন এসে গেলো। এট্রেনটি ব্রিটিশদের। এতে অধিকাংশ যাত্রীই ইংলন্ডের বিভিন্ন এলাকা থেকে নিজেদের পরিবার নিয়ে যাচ্ছে। অনেকেই নববর্ষের অবসর যাপনের জন্য বিভিন্ন জঙ্গলে ক্যাম্পিং এর জন্য যাচ্ছিলো। তরুণী মেয়েরা ও বাচ্চা ছেলে মেয়েরা হাসতে হাসতে গাইতে যাচ্ছিলো।
একটি কম্পার্টমেন্টের জানালা দিয়ে কয়েকটি বাচ্চা ছেলে হাত তালি দিয়ে উঠলো। কারণ, তারা তাদের প্রিয় আইসক্রিমের গাড়িটি দেখে ফেলেছে। গুল মুহাম্মদ দেখলো বাচ্চাদের পেছনে তিন ইংরেজ দাঁড়িয়ে আছে। ট্রেন চলছিলো ধীরগতিতে। ঐ কম্পার্টমেন্টটি যেই গুল মুহাম্মদের রাইফেলের নল বরাবর এলো সঙ্গে সঙ্গে দুই তুর্কির রাইফেল গর্জে উঠলো। প্রথম দুই গুলিতে দাঁড়ানো দুই ইংরেজ মারা গেলো। পরের দুই গুলিতে এক ইংরেজ মাহিলা ও এক ইংরেজ যুবক মারা গেলো।
গুলি লেগে কয়েকটি জানালার কাঁচ ভেঙ্গে গেলো। এতে কয়েকটি বাচ্চাসহ বেশ কিছু যাত্রী আহত হলো। যাত্রীদের মধ্যে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেলো। আতংকে কয়েকজন যাত্রী চলন্ত ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়লো। কেউ একজন ট্রেনের শিকল টেনে দেয়াতে ট্রেন থেমে পড়লো।
রেল লাইনের কাছে পিঠেই রেল কর্মীদের ব্যবহারের জন্য একটি স্টিলের টেলিফোন বক্স ছিলো। ইঞ্জিনের ফোরম্যান সেই বক্স খুলে পুলিশ স্টেশনে ফোন করলো। জানালো, অমুক স্থানে আচমকা ট্রেনের ওপর ফায়ারিং হচ্ছে। কয়েকজন যাত্রী মারা গেছে। অনেক আহত হয়েছে। পুলিশ ইনস্পেক্টর এডওয়ার্ড মিল্লার ফোনের কথাগুলো শুনে ভাবলেন, যে ফোন করেছে সে হয় কোন রসিক লোক। না হয় সে এক ড্রাম মদ খেয়ে টাল হয়ে গিয়েছে।
কিন্তু ফোরম্যান যখন তাকে বললো, যেখান থেকে গুলি আসছে সেখানে একটি পতাকা উড়ছে। পাতাকাটির জমিন লাল এবং তাতে তারকা খচিত রয়েছে। আর সেখানে একটি আইসক্রিমের গাড়িও দাঁড়িয়ে আছে। ইনস্পেক্টর এই ঘোড়া সমেত আইসক্রিমের গাড়ি চিনতেন এবং গাড়ির মালিক গুল মুহাম্মদকেও চিনতেন। তিনি বুঝে গেলেন, অষ্ট্রেলিয়ায়ও বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে।
ইনস্পেক্টর এডওয়ার্ড মিল্লার লাফিয়ে উঠে তার অফিসের কাছেই অবস্থিত ফৌজি ক্যাম্পে গিয়ে জানালেন, এখান থেকে দুই মাইল দূরে কি ঘটছে। তাকে আশিজন ফৌজ দেয়া হলো। এই ফোর্সে তার অনেক কনস্টেবল নিয়ে নিলেন। ফৌজ ও পুলিশের এই বিশাল দল তখনই পৌঁছে গেলো যুদ্ধের ময়দানে।
তুর্কিরা ততক্ষণে আগের পজিশন ছেড়ে আরো দূরের এক পাহাড়ে চলে গেছে। পাহাড়ের উঁচু এক জায়গায় স্থাপন করেছে তাদের পতাকা। তারা নিশ্চিত জানতো, পুলিশ বা ফৌজ অবশ্যই আসবে। তখনই শুরু হবে আসল যুদ্ধ। এজন্য তারা পাহাড়ের ওপর পজিশন নেয়াটাই নিরাপদ মনে করলো।
আর্মি ও পুলিশে গঠিত অস্ট্রেলিয়ান এই বাহিনী চাঁদ তারা খচিত পতাকা দেখেই সেদিকে ফায়ার করতে করতে এগিয়ে যেতে লাগলো। তারা এগুচ্ছিলো এমনভাবে যেন মজা করে চোর পুলিশ খেলছে। কিন্তু তুর্কিরা তাদের এই মজা মজা ভাব আর আনন্দ দূর করে দিলো। তাদের ফায়ারগুলো মিস হচ্ছিলো না একটিও। অষ্ট্রেলিয়ানরা থেমে গেলো। তারপর এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে হামাগুড়ি দিয়ে বা শুয়ে শুয়ে এগুতে লাগলো। কিন্তু দুই তুর্কি কয়েকজন সৈনিককে যমের বাড়ি পাঠিয়ে দিলো। আরো কয়েকজন আহত হলো। গালি দিতে দিতে অন্যরা পিছু হটে এলো।
***
সরাসরি এই হামলা যখন ব্যর্থ হলো ইনস্পেক্টর এডওয়ার্ড মিল্লার তখন এক পাশ থেকে হামলা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তার প্রধান কনস্টেবল জেক মিলাজকে নিয়ে তিনি তুর্কিদের পেছন দিক থেকে এগুতে শুরু করলেন। দুজনই চাপা পায়ে এগুচ্ছিলো। দুশ গজ যাওয়ার পর তুর্কিরা তাদের দেখে ফেললো। সঙ্গে সঙ্গে তিনবার ফায়ার হলো। একটি গুলি কনস্টেবল জেক মিলাজের পেটে গেঁথে গেলো। সে পেটে চেপে ধরে পড়ে গিয়ে ছটফট করতে লাগলো। আরেকটি গুলি এডওয়ার্ডে মিল্লারের উরু ছিঁড়ে বেরিয়ে গেলো। তার গলা দিয়ে গগণ বিদারী চিৎকার বেরিয়ে এলো। দুজনে বড় কষ্টে গড়াতে গড়াতে পিছু হটে এলো।