স্থানীয় কমান্ডাররা উভয় পক্ষের মধ্যে সমঝোতা কনফারেন্স করার সিদ্ধান্ত নিলো। শত্রুপক্ষ থেকে ৯নং শিখ রেজিমেন্ট থেকে এলেন কমান্ডিং অফিসার চাঙ্গাপা আর এদিক থেকে গেলেন কর্নেল হক নেওয়ায় কিয়ানী।
শত্রু দলের কমান্ডিং অফিসার কর্নেল চাঙ্গিয়া কনফারেন্সের শুরুতেই দাবী করলেন, তাদেরকে জম্মু বিলিজের রাস্তা দিয়ে দিতে হবে। তার এই দাবীর সুর অনুরোধের নয়, বরং স্পষ্ট হুমকির। কর্নেল হক নেওয়ায কিয়ানী চ্যালেঞ্জ গ্রহণের দৃঢ়তায় তার দাবী প্রত্যাখ্যান করলেন। এই কনফারেন্সটি অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালে। দুই কর্নেলের দ্বিতীয় সাক্ষাৎ ঘটে একই বছরের ৩ মে।
দ্বিতীয় সাক্ষাতে কর্নেল চাঙ্গাপা কর্নেল হক কিয়ানী কে বললেন, আমাদের ব্রিগেড কমান্ডার বলেছেন, আযাদ কাশ্মীরের ফোর্স যেন বীরুওয়ালী নাড় ক্যাম্পটি খালি করে দেয় অথবা জম্মু বিলিজের গিড্ডীর পাথর ক্যাম্প ছেড়ে চলে যায়। না হয় আমরা বীরু ওয়ালী নাড় এর পথ খুলবো না।
কর্নেল হক নেওয়া কিয়ানী অসম্ভব শীতল দৃষ্টি হেনে তাকালেন কর্নেল চাঙ্গাপা এর দিকে। চাঙ্গাপা সে দৃষ্টির সামনে যেন কেঁপে উঠলেন। তার সে দৃষ্টি– অন্যদিকে কিরিয়ে হক কিয়ানী বললেন, আমরা নিজেরাই রাস্তা খুলে নিবো। একথা বলে কর্নেল কিয়ানী উঠে দাঁড়ালেন।
তাহলে প্রথম গুলি আমাদের রাইফেল থেকে বের হবে না। কর্নেল চাঙ্গাহা দ্রুত হেসে বললেন।
কর্নেল এমন ভাব করলেন যেন তার কথা শুনতেই পাননি। বা শুনলেও কিছু এসে যায় না এতে। তিনি চলে গেলেন। তার সঙ্গে ছিলেন মেজর ইতশতিয়াক আহমদ ও মেজর ইয়ার আফজাল আফরিদী।
কর্নেল কিয়ানী তার অধীনস্ত অফিসারদেরকে, জোয়ানদের বেটা বলে সম্বোধন করতেন। তিনি সেনা ক্যাম্পে ফিরে এসে মেজর ইশতিয়াক ও মেজর আফ্রিদীকে বললেন।
দেখো বেটা! আমরা নিজেরাই আমাদের পথ খুলে নিতে পারবো ইনশাআল্লাহ। তার গলায় এমন দৃপ্ত উচ্চারন ছিলো যে। দুই মেজরও দারুণ সংকল্পবদ্ধ হয়ে উঠলেন।
রাতেই এগারটা পঞ্চান্ন মিনিটে শত্রুদল আযাদ কাশ্মীরের মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পগুলোতে মুহুর্মুহু গুলি বর্ষণ শুরু করলো। ভোর ৪ টার দিকে দুশমনে ৪নম্বর মহার রেজিমেন্ট আজ কাশ্মীরের বীরুওয়ালী নাড় এর ওপর এলোপাথাড়ি আক্রমণ শুরু করলো। এ ক্যাম্পটি আগ থেকেই শক্রদলের ঘেরাও এর মধ্যে ছিলো। তার ওপর দুশমন কয়েক দিন থেকেই সে ক্যাম্পের রসদ সরবরহের রাস্তাও বন্ধ করে রেখেছিলো।
সে ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন জাভেদ আনওয়ার। যার কাছে রেশন তো ছিলোই না। ইমোনেশনও ছিলো সীমিত। তবুও তার উপস্থিত বুদ্ধি-কৌশল ও বীরত্বপূর্ণ নেতৃত্বে জোয়ানরা পাল্টা জবাব দিতে পুরো করলো।
শত্রুপক্ষ নিশ্চিত ছিলো ইমোনেশন খতম হলেই ক্যাপ্টেন জাবেদ আনওয়ার আত্মসমর্পণ করবেন বা ক্যাম্প ছেড়ে তার বাহিনী নিয়ে পালিয়ে যাবেন।
অবস্থা দৃষ্টে তাই মনে হচ্ছিলো। কিন্তু আযাদ কাশ্মীরের এই যুবক ক্যাপ্টন ও তার মুষ্টিমেয় জোয়ানরা জানবাজি রেখে লড়তে লাগলো। কর্নেল হক নেওয়াজ কিয়ানী তৎক্ষনাৎ জবাবী হামলার প্ল্যান ঠিক করে ফেললেন। সেটা তার ব্রিগেড কমান্ডার আতা মুহাম্মদকে দেখালেন। ব্রিগেডিয়ার কমান্ডার ডিভিশন কমান্ডার মেজর জেনারেল আবদুল মাজীদ মালিককে রিপোর্ট করলেন। তিনি তখন ছিলেন মীরি শহরে। মাত্র একদিন হয় তিনি সেখানে সিকড়ি থেকে বদলি হয়ে এসেছেন।
মেজর জেনারেল আবদুল মজীদ মালিক তখনই হেলিকপ্টার যোগে লিগা উপত্যকায় এসে পৌঁছলেন। হেলিকপ্টার অবতরণের পূর্বেই শত্রুপক্ষ ও মুক্তি বাহিনীর অবস্থান তিনি দেখে নিলেন। কর্নেল হক কিয়ানীর প্ল্যান তার সামনে রাখা হলো। অধিক চিন্তা ভাবনার সময় ছিলো না। দুশমনের অনবরত গুলি বর্ষণ ও আক্রমণের প্রচন্ডতা এমন তীব্র ছিলো যে, পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিলো, অবিলম্বে পাল্টা ব্যাবস্থা না নিলে পুরো উপত্যকায় শত্রুপক্ষ ছেয়ে যাবে। জেনারেল মজীদ মালিক কর্নেল কিয়ানীকে জবাবী হামলার অনুমতি দিয়ে দিলেন। হামলা শুরুর সময় ঠিক হলো রাত আড়াইটা।
চক পাতরা নামক এক পাহাড়ের ওপর হামলা করতে হবে। চক পাতরা পাহাড়ের উচ্চতা সাড়ে নয় হাজার ফিট। এই সাড়ে নয় হাজার ফিট উচ্চতা অতিক্রম করে হামলা করতে হবে। আযাদ কাশ্মীরের ফোর্সের যুদ্ধ শক্তি বলতে ছিলো কেবল এক প্লাটুন সৈন্য। তাও বিভিন্ন পাহাড়ের চূড়ায় মোচাবদ্ধ অবস্থায় বিক্ষিপ্ত তারা। চারটি মাত্র তোপ কামান ছিলো তাদের। যার গোলা বড় জোর মাত্র তিন মাইল দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে। আর ছিলো ১২০ মিলি মিটারের দুটি মর্টার গান। এর বিপরীতে শত্রুপক্ষের ছিলো পুরো ব্রিগেড। আর এর সঙ্গে ছিলো পঁচানব্বই পাউন্ড গুলি। নয় মাইল রেঞ্জের ছয় মিডিয়াম তোপ। শত মাইল রেঞ্জের বারটি ফিল্ড তোপও বিশটি মর্টার গান।
আযাদ কাশ্মীরের মুক্তিকামী জোয়ানরা পাহাড় চড়তে শুরু করলো। তদের মাথার ওপর সাক্ষাৎ মৃত্যু দূত হয়ে দুশমন মোর্চাবদ্ধ হয়ে অবস্থান করছে। জোয়ানরা জায়গায় জায়গায় পুতে রাখা মাইনের মধ্য দিয়ে পথ করে অবিরাম পাহাড় জয় করার মতো এগিয়ে যাচ্ছে। ওরা কোন ধরনের অঘটনে না পড়ে সঠিক সময়েই তাদের টার্গেটে পৌঁছে গেলো।