উধাম শিং এসব নিয়ে ভাবছিলেন। এসময় মুজাহিদদের এক গুপ্তচর খবর পাঠালো যে, ইসমাঈলের (উধাম শিং) ইসলাম গ্রহণের সংবাদ বুধ শিং পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। বুধ শিং হুকুম দিয়েছে, ইসমাঈলের মা ও বোনকে পাকড়াও করে নিয়ে যেতে। উধাম শিং-এর গাদ্দারীর শাস্তি তার মা ও বোনকে দিতে চাচ্ছিলো বুধ শিং। বুধ শিং-এর হুকুমে দশ বারজন শিখ সে গ্রামের দিকে রওয়ানাও হয়ে গেছে।
সায়্যিদ আহমদ শহীদ এ দিক থেকে ইসমাঈলের সঙ্গে দশ বারজন মুজাহিদ পাঠিয়ে দিলেন। মুজাহিদদের এই দল যখন সেখানে পৌঁছলো পুরো গ্রামে তখন আতংক বিরাজ করছে। কারণ, বুধ শিং-এর সিপাহীরা আগেই পৌঁছে গিয়েছিলো। দেখা গেলো, শিখেরা একটি বাড়ি ঘেরাও করে আছে। উভয় দলের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শুরু হলো। হিম্মত খান ও ইসমাঈল চেষ্টা করছিলেন বাড়ির ভেতর ঢোকার। কিন্তু তাদের চেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছিলো। অবশেষে বাড়ির পেছন দিক দিয়ে উভয়ে ভেতরে ঢুকলেন।
ভেতরে গিয়ে দেখা গেলো, ইসমাঈলের মা তলোয়ারের আঘাতে মরে পড়ে আছে। তার বোন প্রতীম কোড়ের কাপড় ছিন্নভিন্ন। মাথার চুল এলোমেলো। প্রতীম কোড় জানালো, শিখ সিপাহীরা ভেতরে এসেই প্রতীম কোড়কে ধরে তার কাপড় ছিঁড়তে শুরু করলো। এসময় তার মা তলোয়ার বের করে শিখদের ওপর হামলা করে বসলেন। কিন্তু এক মহিলার পক্ষে দুই শিখের বিরুদ্ধে লড়া সম্ভব ছিলো না। দুজনে তাকে শেষ করে দিলো।
তারা প্রতীম কোড়কে বে-আবরু করতে চাচ্ছিলো। এসময় বাইরে মুজাহিদরা এসে হামলা চালায়। তখন ভেতরের দুই শিখ বাইরে গিয়ে শিখদের লড়াইয়ে শরীক হয়। এর পরপরই হিম্মত খান ও ইসমাঈল (উধাম শিং) ভেতরে চলে আসে। এভাবে প্রতীমের আবরু বেঁচে যায়। ওরা প্রতীমকে বাড়ির পেছনের দরজা দিয়েই বের করে নিয়ে যায়।
মুজাহিদদের মধ্যে দুজন শহীদ হয়। আর শিখদের মধ্যে মারা যায় নয় জন। বাকীরা পালিয়ে যায়।
পরদিন প্রতীম কোড়ও মুসলমান হয়ে যায়। তার নাম রাখা হয়, যায়নাব। ষোড়ষী কন্যা যায়নাব যেমন দেহ সৌন্দর্যে আকর্ষণীয় ছিলো তেমনি ছিলো তার অসাধারণ রূপের ছটা। এক নজর দেখেই হিম্মত খানের ভেতর আলোড়ন শুরু হয়ে যায়। সুদর্শন হিম্মত খান তো যায়নাবের জন্য ছিলো নয়া জীবনদাতা স্বরূপ। ওদের মনের নীরব আকুতি যেন ইসমাঈলকে (উধাম শিংকে)ও ছুঁয়ে যায়। তার অনুরোধে সায়্যিদ আহমদ দুজনকে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ করেন।
সায়্যিদ আহমদ ইসমাঈলের জন্য কান্দাহারের এক মুজাহিদ কন্যাকে ঠিক করেন। কিন্তু ইসমাঈল জানান, পরবর্তী লড়াইয়ে মুজাহিদদের বিজয়ের পরই তিনি বিয়ে করবেন। কিন্তু পরবর্তী লড়াইয়ে খাদী খান নামে এক মুসলমানের গাদ্দারীর কারণে ইসমাঈল (উধাম শিং) বেকায়দায় পড়ে শহীদ হয়ে যান।
কাজী আবদুল হালিম আসর আফগানী রুহানী কবিতা গ্রন্থে লিখেছেন, অল্প সময়ের মধ্যেই ইসমাঈল সায়্যিদ আহমদ শহীদের অত্যন্ত প্রিয়ভাজন হয়ে উঠেছিলেন। তাই তার লাশ দেখে সায়্যিদ আহমদ অঝোর ধারায় কেঁদে উঠেন। রুদ্ধ কণ্ঠে বলেন
হায়! শেষ পর্যন্ত আমার প্রিয় বন্ধুটিও শাহাদাঁতের পাগড়ী পরে নিলো!
উড়ন্ত ঝাণ্ডা
উড়ন্ত ঝাণ্ডা
১৯১৫ এর ১লা জানুয়ারী। অষ্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে এমন এক ফৌজ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লো যার নজির পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। কারণ, সে ফৌজের সদস্য ছিলো মাত্র দুজন। তাদের যুদ্ধের সরঞ্জাম ছিলো এরকম- ঝং ধরা দুটি রাইফেল। প্রায় দেড় রাউন্ড গুলি। তাদের একজন ছিলো, ঘোড়ায় চড়ে পথে ঘাটে ঘুরে আইসক্রিম বিক্রেতা প্রায় বৃদ্ধ এক লোক। তার নাম গুল মুহাম্মদ। আরেকজন হলো মোল্লা আব্দুল্লাহ। ত্রিশ বছরের নওজোয়ান।
তাদের ঝাণ্ডা ছিলো এরকম, এক লাল রঙের টেবিলক্লথের ওপর রঙ দিয়ে কয়েকটি তারকার ছবি একে দেয়া হয়। তুর্কিদের পতাকা এমন হয়।
দক্ষিণ অষ্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ভিলেজের ছোট একটি জায়গা- ব্রকন হলের লোকেরা তাদের প্রতিবেশী দুই মুসলমান গুল মুহাম্মদ ও মোল্লা আব্দুল্লাহকে আফগান বলে জানতো। তখন অষ্ট্রেলিয়ার অধিকাংশ জায়গাতেই মরু অঞ্চল ছিলো। তাই সেখানে সাধারণ বাহন ছিলো উট। এসব হাজার হাজার উটের চালক ছিলো আফগানিস্তানের লোকেরা। ইংরেজরা তাদেরকে সেখানে নিয়ে যায়।
অনেক পরে প্রকাশ পায় যে, গুল মুহাম্মদ ও মোল্লা আব্দুল্লাহ তুর্কি। যারা নিজেদের মাতৃভূমির ক্ষেত্রে একেবারেই অন্ধ। বরং বলা যায় উন্মাদ দেশ প্রেমিক।
১৯১৪ সনে ইংরেজ ও তাদের মিত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে তুর্কিরা যুদ্ধ শুরু করে। কিন্তু ষাট বছরের গুল মোহাম্মদ সেটা ১৯১৫ এর ১লা জানুয়ারি শুনতে পায়, তুর্কিরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদের ঘোষণা দিয়েছে। আর অষ্ট্রেলিয়া ইংরেজদের করদ রাজ্য।
গুল মুহাম্মদ এটা শুনেই জিহাদের জোশ জযবায় উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে তার তুর্কি সঙ্গী মোল্লা আব্দুল্লাহর বাড়িতে দৌড়ে গিয়ে হাজির হলো। মোল্লা আব্দুল্লাহ ব্ৰকন হলে ধোপর কাজ করতো। ব্রন হলে এ দুজনেই তুর্কি ছিলো।
শোন ভাই- গুল মুহাম্মদ মোল্লা আব্দুল্লাহকে বললো, আমাদের প্রিয় তুর্কিস্তান ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদের ঘোষণা দিয়েছে। এর অর্থ হলো, তুর্কিরা যেখানেই থাকুক তাদেরকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে। আর জানোই তো অষ্ট্রেলিয়া ইংরেজদের দেশ। তাই এদেশের সবার বিরুদ্ধে আমরা জিহাদের ঘোষণা দিলাম।