এসব কারণে উধাম শিংকে তার ভালো লেগেছিলো। সে বললো, উধাম শিং! জীবন মরণ আল্লাহর হাতে। কিন্তু আমি তোমাকে এখানে এভাবে মরতে দেবো না। তোমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করবো।
উধাম শিং পড়ে ছিলেন বেহুশ হয়ে। শুনতে পাচ্ছিলেন না কোন কিছুই। এত বড় দেহধারী এক লোককে হিম্মত খান উঠিয়ে নিলো তার কাঁধে।
***
উধম শিং-এর জ্ঞান ফেরার পর ধীরে ধীরে চোখ খুললেন। এদিক ওদিক তাকালেন। ওপরে তাকিয়ে দেখলেন তার ওপর ছাদ। তার সামনে স্বল্প পরিচয়ের এক যুবক বসে আছে। উধাম শিং নিজের ডান বাহুও মাথাটি বেশ ভারি মনে হলো। শক্ত ব্যন্ডেজে বাঁধা মাথা ও ডান বাহুটি। তিনি হয়রান হয়ে ক্ষীণ কণ্ঠে বিড় বিড় করে উঠলেন- হিম্মত খান? … আমাকে তুমি এখানে নিয়ে এসেছো?
হিম্মত খান যখন তাকে বললো কিভাবে এখানে উঠিয়ে আনা হয়েছে তখন তো উধাম শিং-এর হয়রানি স্তব্ধতায় রূপান্তরিত হলো। তিনি জানেন, এ এলাকার পথঘাট কেমন কঠিন। তাই তার মতো এমন দেহধারী কাউকে উঠিয়ে আনা সাধারণ ব্যাপার নয়।
আমীরুল মুমিনীন তাশরীফ আনছেন- এ সময় একজন ভেতরে এসে বললো।
হিম্মত খান উঠে দাঁড়ালো। সায়্যিদ আহমদ শহীদ ভেতরে এলেন। উধাম শিং উঠে বসলেন। সায়্যিদ আহমদের দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে রইলেন।
আমাকে বলা হয়েছে আপনার যখম ততটা গভীর নয়- সায়্যিদ আহমদ উধাম শিং-এর মাথায় হাত রেখে বললেন- আশা করা যায় দ্রুতই সেরে উঠবেন। হিম্মত খান আমাকে বলেছে লাহোরের কেল্লায় আপনি তার সঙ্গে খুব ভালো আচরণ করেছেন। আমাদের ব্যবহারও আপনাকে হতাশ করবে না।
আমি আপনার কয়েদী- উধাম শিং বললেন- আমার সঙ্গে যেমন ইচ্ছে তেমন ব্যবহার করতে পারেন আপনি। আমার হতাশার কারণ ঘটলেও আমি আপনার কিইবা বিগড়াতে পারবো।
আপনি আমাদের কয়েদী নন- সায়্যিদ আহমদ স্মিত হাস্যে বললেন যখম সেরে উঠা পর্যন্ত আপনি আমাদের মেহমান। তারপর আপনাকে একজন কেল্লাদারের উপযুক্ত সম্মান দিয়ে বিদায় করা হবে। আমি আপনার জন্য দুআ করবো, আপনি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবেন।
তিনি উধাম শিং-এর মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলেন।
উধাম শিং-এর দৃষ্টি দরজার মধ্যে আটকে রইলো যেখান দিয়ে সায়্যিদ আহমদ বের হয়েছিলেন।
আপনি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবেন- কথাটার মধ্যে তিনি এক আশ্চর্য নির্ভরতা খুঁজে পেলেন। এক অপার্থিব শক্তিমত্তা যেন তার কথার মধ্যে নিহিত ছিলো। এমনটি আর তিনি কারো মধ্যে দেখেননি। হিম্মতখানের কথায় তিনি চমকে ধ্যানভগ্ন হলেন
ইনিই সায়্যিদ আহমদ। আমাদের সালারে আলা এবং আমীরুল মুমিনীন। যার ব্যাপারে আপনি আমাকে লাহোরের কেল্লায় জিজ্ঞেস করেছিলেন।
হ্যাঁ, এক আশ্চর্য আকর্ষণ টের পেলাম আমি উনার মধ্যে- উধাম শিং বললেন।
উধাম শিংকে যে ঘরে রাখা হয়েছিলো সেটা ছিলো আকোড়া থেকে সামান্য দূরের ছোট একটি গ্রামের দালান বাড়ি। প্রতিদিনই উধাম শিং-এর যখমে নতুন পট্টি লাগানো হতে লাগলো। দেয়া হতে লাগলো খুবই উন্নতমানের খাবার দাবার। সায়্যিদ আহমদ শহীদ তাকে দেখতে আসতেন প্রতিদিনই। উধাম শিং যে, শত্রু পক্ষ বা অমুসলিম-আচার আচরণে কেউ কখনো তা প্রকাশ করেনি। রোজ সকালে তার কানে আসতো বড় সুমধুর সুর ধ্বনি। উধাম শিং বুঝতে পারলেন কেউ কুরআন পড়ছে। আগেও তিনি কুরআন পড়ার আওয়াজ শুনেছেন, কিন্তু এধরনের ভিন্ন ধরনের অনুভূতি কখনো তার হয়নি।
একদিন হিম্মত খান তার কাছে বসাছিলো। উধাম শিং যেন অস্থির হয়ে বলে উঠলেন
হিম্মত খান! আমি শিখ। আমার প্রতি এত মেহেরবান হয় না। আরে আমরা তো মুসলমানদেরকে কষ্ট দিয়ে খুঁচিয়ে খুচিয়ে মেরে আনন্দ বোধ করি। মুসলমান মেয়েদের ইজ্জত লুটে নেচে গেয়ে উঠি। মুসলমান শিশুদের হত্যা করে হো হো করে হেসে উঠি। তাহলে তোমরা আমার সঙ্গে কেন মেহমানের মতো আচরণ করবে।
আমরা আপনার ধর্ম দেখছি না- হিম্মত খান বললো- দেখছি না যে, আপনি শিখ বা অন্য কোন সম্প্রদায়ের। আমরা এটা মনে রাখি যে, আমরা মুসলমান। আমরা যুদ্ধ করি শুধু রণাঙ্গনে। কিন্তু তখনো নারী, শিশু, বৃদ্ধ, নিরস্ত্র ও যখমীদের ওপর হাত উঠাই না। দেখুন, আমাদের সালারে আলা আপনাদের মহারাজাকে ইসলাম গ্রহণের পয়গাম পাঠিয়েছেন। কিন্তু আপনাকে ইসলাম গ্রহণের কথা বলেননি। কারণ, আপনি আমাদের অনুগ্রহে রয়েছেন এখন। আপনাকে কিছু বলার অর্থই হলো জোর জবরদস্তি করা।
যদি নিজ ইচ্ছায় আমি ইসলাম গ্রহণ করি?
তাহলে আগে আমাদের নিশ্চিন্ত হতে হবে যে, আপনি কারো ভয়ে বা কোন কিছুর লোভে ইসলাম গ্রহণ করছেন না।
তারপর আরো কয়েকদিন কেটে গেলো। একদিন উধাম শিং বাইরে খানিক ঘুরে আসতে বের হলেন। সায়্যিদ আহমদ তখন সে এলাকাতেই ছিলেন। উধাম শিং খুঁজে খুঁজে সায়্যিদ আহমদের দেউরী বের করে সোজা তার কামরায় চলে গেলেন এবং তার পায়ে পড়ে বলতে লাগলেন- আমাকে মুসলমান বানিয়ে নিন। আমাকে মুসলমান বানিয়ে নিন। তাকে বলা হলো, তিনি এখন সুস্থ-স্বাধীন। এখন ইচ্ছে করলে চলে যেতে পারেন। কিন্তু তার এক কথা- তাকে মুসলমান বানাতে হবে। অবশেষে সায়্যিদ আহমদ তাকে কালেমায়ে তায়্যিবা পড়িয়ে মুসলমান বানিয়ে নিলেন। তার নাম রাখলেন ইসমাঈল।
মুসলমান হয়ে তিনি জানালেন, তার মা ও একটি ছোট বোনও তার সঙ্গে এসেছিলো। তখন সেনা কমাণ্ডার অফিসাররা নিজেদের পরিবার নিয়েই যুদ্ধ সফরে বের হতো। উধাম শিংও তার বোন ও মাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। তাদেরকে সেনা ছাউনিতে না রেখে আকোড়া থেকে একটু দূরের এক আত্মীয়ের গ্রামে রাখেন। তিনি বললেন, তাদেরকে তিনি এখানে নিয়ে আসতে চান। কারণ, সে এলাকাটি এক জালিম শিখ কমাণ্ডারের হাতে রয়েছে।