***
জমাদার আল্লাহ বখশ দেখলেন, যে উদ্দেশ্যে এই গেরিলা হামলা চালানো হয়েছে তার সে উদ্দেশ্য পুরোপুরি সফল হয়েছে। তাই তিনি কয়েকজন কাসেদকে বললেন, চিৎকার করে করে মুজাহিদদের ডেকে বলল, তাঁবু পল্লী থেকে বের হয়ে নদীর তীরে পৌঁছতে। জমাদার নিজেও উঁচু আওয়াজে নির্দেশ দিতে লাগলেন। কিন্তু মুজাহিদরা নিজেদের সফলতায় এতই পরিতৃপ্ত ছিলো যে, কারো কোন দিক নির্দেশনা মানছিলো না।
দশ হাজার সৈন্যের ছাউনির পরিধি ছিলো দুই মাইল এলাকা জুড়ে। হাজার হাজার ঘোড়া, গরু, মহিষ ও এগুলোর গাড়ি, হাতিয়ার, বন্দুক, বারুদ এসব মুজাহিদরা একত্রিত করছিলো।
অবশেষে আকবর খান নামে সহকারী এক কমাণ্ডারের প্রচেষ্টায় মুজাহিদদের তবু পল্লী থেকে বের করা সম্ভব হলো। তখনো বন্দুকের ফায়ার হচ্ছিলো। কোথাও কোথাও বিচ্ছিন্ন লড়াই হচ্ছিলো।
জমাদার আল্লাহ বশ মুজাহিদদের তাঁবু পল্লী থেকে বের করে নিয়ে যাওয়ার জন্য ছুটাছুটি করছিলেন। হঠাৎ এক বন্দুকের ফায়ার তাকে ছিন্নভিন্ন করে দিলো। তিনি শহীদ হয়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে সহকারী কমাণ্ডার আকবর খান মুজাহিদদের নেতৃত্ব নিয়ে নিলেন নিজ হাতে।
ফজরের সময় মুজাহিদরা তাঁবু পল্লী থেকে প্রায় দুই মাইল দূরে চলে গেলো। একটি ফাঁকা জায়গায় সবাই ঘোড়া থামালো। তারা প্রথমে যে কাজটা করলে সেটা হলো, প্রথমে আযান দিয়ে সবাই ফজরের নামায আদায় করলো। তারপর শহীদদের মাগফিরাত কামনা করে দুআ করা হলো। ফজরের জামাআতে যারা অনুপস্থিত ছিলো তাদের মধ্যে হিম্মত খানও ছিলো। তার ব্যাপারে সাবই ধরে নিলো সে শহীদ হয়ে গেছে।
কমাণ্ডার উধাম শিং-এর তাবু ছিলো একটু দূরে। হামলার আওয়াজ শুনে তিনি হড়বড় করে উঠলেন। সে অবস্থাতেই বাইরে বেরিয়ে এলেন। ভয়ে তিনি কেঁপে উঠলেন। তার দশ হাজার ফৌজকে পাইকারী দরে হত্যা করা হচ্ছিলো। তিনি বুধ শিং ও হরি শিং-এর তাঁবুর দিকে দৌড়ে গেলেন, কিন্তু তাদের তাবু খালি ছিলো। তিনি তো জানতে পারলেন না, মুসলমানদের এই হামলা দেখে তারা ভেবেছে বিরাট এক সৈন্য বাহিনী শিখদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এখন প্রাণ বাঁচানো ছাড়া আর কিছুই করা যাবে না।
উধাম শিং দেখলেন তার ফৌজ সমানে কচু কাটা হচ্ছে। তার করার কিছুই ছিলো না। তিনি কমাণ্ডও নিতে পারছিলেন না। পালাতেও চাচ্ছিলেন না তিনি। তিনি জানতেন, কোন ফৌজের যখন এ অবস্থা হয় তখন কমাণ্ডার তাদেরকে নিজ নিয়ন্ত্রণে নিতে পারে না।
তিনি তার অস্ত্রও কোষমুক্ত করলেন না। একদিকে হাটা ধরলেন। তাঁবুর ধিকি ধিকি আগুন ও মশালের আলোয় দেখা যাচ্ছিলো, তিনি কোন দিকে যাচ্ছেন। শিখ সৈন্যদের লাশের গায়ে কখনো কখনো ঠোকর খাচ্ছিলেন। তখনো বন্দুক থেকে ফায়ার হচ্ছিলো অনবরত। হঠাৎ এক বন্দুকের সামনে তিনি পড়ে গেলেন, অধিকাংশ গুলি লাগলো তার দুই বাহুতে। একটা লাগলো বুকের এক পাশে। আরেকটা মাথার খুলি ছিঁড়ে নিয়ে গেলো। তিনি তাঁবু পল্লী থেকে বের হচ্ছিলেন। এই গুলির আঘাতেও তিনি হাটা থামালেন না। হেলে দুলে সামনে এগুচ্ছিলেন। এক সময় তাঁবুপল্লী থেকে বের হয়ে গেলেন। পাথর বেষ্টনীর গায়ে ধরে ধরে হাটছিলেন। কিন্তু বুলেটের ক্ষত থেকে অনবরত রক্তক্ষরণ তাকে বেশি দূর এগুতে দিলো না। এক সময় জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলেন।
হিম্মত খান তাঁবু থেকে বের হলো তখন যখন তার সঙ্গীরা সবাই অনেক দূর চলে গেছে। এক জায়গায় দুই শিখ অতর্কিতে তাকে ধরে ফেলেছিলো, সে দুজনের সঙ্গে তার তুমুল লড়াই হয়। বহু কষ্টে হিম্মত খান দুই শিখকে তাবুতে এনে চরম যখমী করে সেখান থেকে সরে আসে। সে তার অপমানের প্রতিশোধ এক প্রকার নিয়ে নিয়েছে। তবুপল্লী থেকে বের হওয়ার সময় তাবুগুলোর ধ্বংস লীলা প্রত্যক্ষ করলো হিম্মত খান। তার কাছে বড় বিস্ময়কর ঠেকলো। তার কাছ দিয়ে শিখেরা পালানোর জন্য ছুটাছুটি করছিলো। তার দিকে কেউ ক্ষেপও করছিলো না যে, তাদের এক মহান শত্রু এখানে দাঁড়িয়ে আছে।
হিম্মত খান পাথর বেষ্টনী ঘেষে এগুচ্ছিলো। যেদিকে বেষ্টনী শেষ হয়েছে সেখান থেকে জমি ঢালু হয়ে নিচের দিকে চলে গেছে। সে নিচের দিকে নামতে লাগলো। কিছু দূর যাওয়ার পর দেখলো, তার দুপাশে ছোট দুটি টিলা। এক পাশে দেখলো একটি লাশ পড়ে আছে। এতে তার কোন সাথী-সঙ্গীও হতে পারে। সে দৌড়ে সেদিকে গেলো।
না, একতার কোন সঙ্গী নয়। এক শিখ। ঘৃণায় তার মুখ কুচকে যাওয়ার কথা ছিলো। উচিত ছিলো তার সেখান থেকে তাচ্ছিল্য ভরে চলে আসা। কিন্তু একজন মৃত মানুষকে দেখলে আর ধর্মের ভেদাভেদের কথা তার মনে থাকে না।
চারদিক ফর্সা হয়ে আসছিলো। ভোরের আবচ্ছা আলোয় লাশের চেহারা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো। কয়েক মুহূর্ত দৃষ্টি লাশের মুখের ওপর আটকে থাকতেই হিম্মত খান সহসা তাকে চিনতে পারলো। তার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো- উহহু, এতো উধাম শিং।
হিম্মত খান সঙ্গে সঙ্গে তার নাড়ি পরীক্ষা করলো। এখনো বেঁচে আছে। লাহোর কেল্লায় উধাম শিং তার সঙ্গে যে আচরণ করেছিলো এটা তার মনে পড়লো। তার কারণেই হিম্মত খান নিজের সঙ্গে তলোয়ার রাখতে পেরেছিলো। সসম্মানে মেহমানখানায় থাকতে পেরেছিলো। এমনকি রঞ্জিৎ শিং-এর দরবারে হিম্মত খানের দ্ব্যর্থহীন কথা শুনে যখন সমস্ত দরবারীরা আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে তলোয়ার নিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো তখন সে উধাম শিংকে দেখেছিলো যে, উধাম শিং এক মাত্র দরবারী … যে নির্বিকার ভঙ্গিতে নিজ আসনে বসে ছিলেন, তলোয়ার থেকে তার হাত দূরে রেখেছিলেন। এও কি হিম্মত খানের সম্মানের জন্য নয়? প্রথম রাতে হিম্মত খানের প্রতিটি কথাও তো উধাম শিং বড়। মনোযোগ দিয়ে শুনেছিলেন। এছাড়াও হিম্মত খান উধাম শিং-এর মধ্যে দেখছিলো একজন অন্তরঙ্গ মানুষের ছবি।