এই নওজোয়ান শিখ পুরো তাঁবু ছাউনির আশপাশ ঘুরে যেদিক থেকে এসেছিলো সেদিকে চলে গেলো। কিছু দূর যাওয়ার পর সে আওয়াজ শুনতে পেলো- এসে গেছে হিম্মত খান?
সে আওয়াজ লক্ষ্য করে এগিয়ে গেলো।
নওজোয়ান শিখ নয়, হিম্মত খান। শিখদের ছদ্মবেশ ধারণ করেছিলো। শিখ হিসেবে ওকে চমৎকার মানিয়েছিলো। শিখের ছদ্মবেশে সে দুশমনের ছাউনি পর্যবেক্ষণ করতে গিয়েছিলো। তার অপেক্ষায় জমাদার আল্লাহ বখশ এখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হিম্মত খান জমাদার আল্লাহ বখশকে ছাউনির বিস্তারিত অবস্থা জানালো এবং বললো, হামলার জন্য পরিবেশ বেশ চমৎকার।
এর আগে এই গুপ্ত হামলাকারী জানবাজরা স্থানীয় পাঠানদের সাহায্যে ছোট ছোট নৌকায় নদী পার হয়। কারণ, শুকনো পথে জায়গায় জায়গায় শিখসৈন্যরা টহল দিচ্ছিলো। আর সংখ্যায়ও তারা ছিলো অনেক। এজন্য নদী পথ ছাড়া উপায় ছিলো না। নদী পার হয়ে হিম্মত খানকে দুশমনের তাঁবুপল্লীর অবস্থা দেখে আসার জন্য পাঠানো হয়। হিম্মত খান কাটাদার ঝোঁপঝাড় ও পাথর দেয়ালের বেষ্টনীর মধ্যেও একটা জায়গা আবিষ্কার করে, যেখান দিয়ে ভেতরে যাওয়া যাবে।
জামাদার আল্লাহ বশ তার জানবাজ নৈশ হামলাকারীদের শেষ দিকনির্দেশনা দিলেন–
আমরা সবাই পরস্পরকে পরস্পরের মনোমালিন্য, দুঃখ কষ্ট মাফ করে দিলাম। আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না, কে জীবিত ফিরে আসতে পারবে। শুধু এটা মনে রাখবে, আজকের এই গুপ্ত হামলা তোমাদের আখেরী ফরজ শেষ কর্তব্য। এরপর তোমরা আল্লাহর দরবারে চলে যাবে। এখন এই ফয়সালা নিজেরা করে নাও আল্লাহর সামনে আনন্দচিত্তে উপস্থিত হবে, না কর্তব্যে অবহেলা করে অভিশপ্তরূপে নিন্দিত হয়ে যাবে!
কারো মুখ দিয়ে কোন আওয়াজ বের হলো না। কারণ, তাদের নীরবতা বজায় রাখার জন্য কঠিন নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো। তারা আল্লাহু আকবার শ্লোগান বুকের মধ্যে এমনভাবে চেপে ধরে রেখেছিলো যেমন করে খাঁচায় প্রতাপশালী উন্মত্ত কোন প্রাণী বন্দি করে রাখা হয়। আর সে খাঁচা ভাঙ্গার জন্য খাঁচার শিকে থাবা মারতে থাকে।
***
দশ হাজার শিখের তাঁবু পল্লী মরণ ঘুমে বেহুশ হয়েছিলো। দেশী মদের কড়া ঝাঁজ তাদেরকে গভীর ঘুমের দেশে পাঠিয়ে দিয়েছিলো। মদ ছাড়া শিখেরা এমন অথর্ব হয়ে পড়ে যেমন পানি বিহীন চারা নেতিয়ে পড়ে। এজন্য শিখদের পানির আগে দেয়া হয় মদ। মদের তোড়ে নেশাকাতর হয়ে তারা লড়াই করে।
নৈশ প্রহরীরা জেগে ছিলো। তারা টহল দিচ্ছিলো। ও দিকে হিম্মত খানের পেছন পেছন নৈশ হামলাকারীরা ছাউনির পাথর বেষ্টিত ঐ স্থানে পৌঁছলো যেখান দিয়ে ভেতরে যাওয়ার কথা ছিলো। জমাদার আল্লাহ বখশ সে জায়গাটা দেখলেন এবং পাথর বেস্টনের বাইরের কাটাদার ঝোঁপঝাড় এক দিকে ঠেলে দিলেন। সেখান দিয়ে দুজন জানবার্য হাল্কা পায়ে ভেতরে লাফিয়ে পড়লো। এরা ভেতরের ঝোঁপগুলো সরিয়ে দিলো।
এবার আরো কিছু জানবায ভেতরে চলে গেলো। চারজন তলোয়ার তাক করে এক জায়গায় লুকিয়ে পড়লো। যাতে কোন প্রহরী আসলে তাকে নিঃশব্দে খতম করা যায়। হিম্মত খান যখন একলা এসেছিলো তখন এটা দেখতে পায়নি যে, প্রহরীদের হাতে কোন ধরনের অস্ত্র রয়েছে। তাদের কাছে বর্শা নয়, ছিলো দুইনলা বন্দুক।
জানবাদের পুরো দল একে একে ভেতরে চলে গেলো। তারা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে তাঁবুগুলোর রশি কেটে দিলো এবং ওপর থেকে বর্ষ মারতে লাগলো। তাবুর নিচে চাপা পড়া শিখেরা মরণ চিৎকার ছাড়া আর কিছুই করতে পারছিলো না। হাঙ্গামার আওয়াজ শুনে এক প্রহরী বন্দুক দিয়ে এদিকে ফায়ার করলো, সবগুলো গুলি মাওলানা বাকের আলী আজীম আবাদীর বুকে গিয়ে গাঁথলো। তিনি বুক চেপে ধরে উঁচু গলায় আওয়াজ দিলেন
বন্ধুরা! আমার কাছ থেকে হাতিয়ার নিয়ে নাও। এটা আল্লাহ তাআলার আমানত। দুশমনের হাত যেন এতে না লাগে- তিনি পড়ে গেলেন এবং শহীদ হয়ে গেলেন।
এই গেরিলা হামলার তিনি ছিলেন প্রথম শহীদ।
এরপর ভেঙ্গে পড়তে লাগলো এক গজবের পাহাড়। চার দিকে কেয়ামতের বিভীষিকা জ্বলে উঠলো। মুজাহিদরা তাঁবুর রশি কাটতে লাগলো আর বর্শা মারতে লাগলো পড়ন্তু তাঁবুতে। জানবাদের এক দল এক তাঁবুতে আগুন লাগিয়ে দিলো। দশ হাজার শিখের এই বিশাল সেনাবাহিনী। হড় বড় করে জেগে উঠলো। কিন্তু কয়েকশত জাগার আগেই চির নিদ্রায় চলে গেলো। সঙ্গীদের আর্তনাদ ত্রাহি ত্রাহি আওয়াজ এবং আল্লাহু আকবারের গর্জন শুনে তারা পালানো ছাড়া আর কোন কিছুই ভাবতে পারছিলো না।
খুব কম শিখই ঠাণ্ডা মাথায় পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করলো। তারা লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হলো ঠিক। কিন্তু লড়বে কার সঙ্গে। সেখানে পলায়নপর শিখ ছাড়া আর কাউকেই তাদের চোখে পড়ছিলো না।
জমাদার আল্লাহ বশের নজর ছিলো শিখদের তোপখানার দিকে। তার সঙ্গে কয়েকজন জানবায পৃথক করে রেখে ছিলেন। তাদেরকে নিয়ে এক শিখ অফিসারকে পাকড়াও করলেন। তোপের মজুদ কোথায় এটা জানানোর বিনিময়ে তাকে প্রাণে বাঁচিয়ে দেবেন। এভাবে তার কাছ থেকে ওয়াদা নিলেন। শিখ অফিসার তাকে তোপের মজুদ যে তাঁবুতে ছিলো সেদিকে নিয়ে গেলো। আল্লাহ বখশ তাকে ভাগিয়ে দিলেন। এই তোপগুলো এখন মুজাহিদদের।
একটু পরই তাবু পল্পীর কয়েক জায়গায় আগুনের লেলিহান শিখা জ্বলে উঠতে দেখা গেলো। ঘোড়ার ভয়ার্ত চিহি চিহি রব পরিবেশ আরো ভয়ংকর করে তুললো। ছাড়া ছাড়া গুলিও চলতে লাগলো।