১৮২৬ সালের ২১ ডিসেম্বর (১২৪২ হিজরীর ২০ জমাদিউল আউয়াল) সায়্যিদ আহমদ শহীদ এই চার কমাণ্ডারকে নিয়ে আলোচনা সভা করেন। বৈঠক শুরু হয় জোহরের নামাযের পর।
***
এই বৈঠকে চার কমাণ্ডার ছাড়াও অন্যান্য সেনা উপদেষ্টারাও উপস্থিত ছিলেন, সায়্যিদ আহমদ শহীদ উপস্থিত সমবেতদের উদ্দেশ্যে বলেন–
আমাদের গুপ্তচররা খবর দিয়েছে, শিখেরা সংখ্যায় প্রায় দশ হাজার। ওরা ওদের ছাউনির আশেপাশে পাথরের দেয়াল দাঁড় করিয়ে রেখেছে। এরা একে বলে সঙ্গর। এর সঙ্গে এর আশেপাশে কাটাদার ঝোঁপ-ঝাড় দিয়ে এমনভাবে বেষ্টনী তৈরী করে রেখেছে যে, ঘোড়াও সেখান দিয়ে যেতে পারবে না। শিখেরা তাদের তাঁবু এভাবে সংরক্ষণ করে থাকে। আবার তাদের ছাউনির আরেক দিকে আছে নদী।…
অথচ আমাদের মোট সৈন্যসংখ্যা দেড় হাজার মাত্র। মহান আল্লাহ রাব্দুল আলামীনের ঐ ফরমানের কথা স্মরণ করুন যে- যদি ঈমানদাররা দৃঢ় পদ থাকে তাহলে তোমাদের বিশজন তাদের দুইশ জনের ওপর বিজয় লাভ করবে। মুসলমানদের সৈন্য সংখ্যা সব সময়ই কম ছিলো। এই অপূর্ণতা পূরণ করতে হবে ঈমানী শক্তির তীব্রতা দিয়ে …
আপনারা সবাই হয়তো ভেবে থাকবেন এত অল্প সংখ্যক সৈন্য এত বড় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সরাসরি লড়াই করতে পারবে না। এজন্য আমাদের নৈশ হামলা ও গুপ্ত হামলা চালাতে হবে। গুপ্ত হামলা চালিয়েই আমাদের এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়তে হবে গেরিলা হামলার পদ্ধতিতে। আপনাদের মধ্যে কে। আজ রাতে গুপ্ত হামলা চালাতে প্রস্তুত।
কে ছিলো এমন যে বলবে সে প্রস্তুত নয়। কিন্তু সায়্যিদ আহমদ শহীদের দৃষ্টি পড়লো জমাদার আল্লাহ বখশের ওপর। জমাদার আল্লাহ বখ্শ হিন্দুস্তানের আনাও জেলার লোক। তিনি ইংরেজ সেনাবাহিনীতে জমাদার ছিলেন। সায়্যিদ আহমদ শহীদের তাহরীকে মুজাহিদীনের ঝাণ্ডা যখন উচ্চকিত হচ্ছিলো তখনই জমাদার আল্লাহ বখশ এসে তার হাতে বায়আত হন।
প্রিয় মুজাহিদীন! সায়্যিদ আহমদ শহীদ বললেন– খোদায়ে যিলজাল আমাদের নিয়ত ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানেন। আমরা আমাদের ব্যক্তিগত শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য দেশ ত্যাগ করিনি। আমরা ইসলামের নির্দেশিত শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য দেশ ত্যাগ করেছি। হিন্দুস্তানকে কুফরের অপবিত্রতা থেকে পবিত্র করতে হবে।
এখানে যারা উপস্থিত ছিলো তাদের জন্য এ ধরনের ওয়াজের প্রয়োজন ছিলো না। তারা ঘর থেকে বেরই হয়েছে প্রাণ বিসর্জন দেয়ার জন্য। বৈঠকে বসার পূর্বে তারা সায়্যিদ আহমদের পেছনে জোহরের নামায আদায় করে। তারা যখন দুআর জন্য হাত উঠালো তাদের চোখগুলো অশ্রুতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো। মুক্তাদীরা জানতো, তাদের ইমাম আল্লাহর দরবারে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছেন এবং বিজয় ভিক্ষা চাইছেন। অনেক মুক্তাদীর চোখও অশ্রু বন্যায় ভেসে গেলো।
বৈঠকে সায়্যিদ আহমদ শহীদ ঈমানদীপ্ত বক্তৃতার পর জমাদার আল্লাহ বশকে গুপ্ত হামলা সম্পর্কে কিছু দিক নির্দেশনা দিলেন। কিছু আলোচনা পর্যালোচনার পর গুপ্ত হামলার স্কিম তৈরী হয়ে গেলো কতজন গুপ্ত হামলায় যাবে তাও ঠিক করা হলো। এর মধ্যে হিম্মত খানও ছিলো। হিম্মত খান স্বেচ্ছায় এই গেরিলা দলে যোগ দেয়। মহারাজা রঞ্জিৎ শিং-এর দরবারে ওর সঙ্গে যে অপমানজনক আচরণ হয়েছে এর পতিশোধ নেয়ার জন্য সে অধীর হয়ে ছিলো। লাহোর থেকে ফিরতি সফর তার জন্য বড়ই কঠিন ছিলো। অনবরত ঘোড় সওয়ারি, বিশ্রামহীনতা ও কয়েক দিনের ক্ষুধার্ত অবস্থা তার কোমর ভেঙ্গে দিয়েছিলো। কিন্তু তার পরও সে অনেক বলে কয়ে গুপ্ত হামলায় নিজের নাম লেখাতে সমর্থ হয়।
***
আরে মুসলমানরা সংখ্যায় এত নগণ্য যে, আমাদের ছায়ারও তো মোকাবেলা করতে পারবে না ওরা।
আকোড়ার নিকটবর্তী ছাউনিতে রাতে হরি শিং, বুধ শিং ও উধাম শিং এসব বলাবলি করছিলো। ওদের আওয়াজ বলে দিচ্ছিলো, ওরা মদের নেশায় চুর হয়ে যাচ্ছে।
হরি শিং বলে উঠলো– বুধ শিং তুমি তো সায়্যিদ আহমদের নাম শুনে ভয় পেয়ে গিয়েছিলে। না হলে কি আর সেনা সাহায্য চেয়ে পাঠাও!
আরে হরি শিং! বুধ শিং হরি শিং-এর রানে চাপড় মেরে বললো- ঠিক আছে লড়াই না হলেও কিছু দিন তো এখানে মৌজ করে যেতে পারবে। আর আমি সায়্যিদ আহমদের নাম শুনে ভয় পায়নি … তুমিও ভেবে দেখো … এই মুসলে (মুসলমান শালারা) … এদের ওপর ভরসা করা যায় নাকি? … শালারা অনেক দিন এদেশে হুকুমত করেছে। এরা যদি একবার উঠে দাঁড়াতে পারে তাহলে না হরি শিং থাকবে না থাকবে বুধ শিং। তোমাদের মহারাজা রঞ্জিৎ শিং তো মুসলমানদের কিছুই মনে করছে না।
কাছে বসে উধাম শিং হাসছিলেন। তিনিও বললেন, মুসলমানরা যদি নিজেদের আত্মহত্যা করতে না চায় তাহলে এই সামান্য সংখ্যক ফৌজ নিয়ে আমাদের মোকাবেলা করতে আসবে না।
এই শিখ কমাণ্ডাররা যখন মদের নেশায় পুরো মাতাল হয়ে আবোলতাবল বকছিলো তখন শিখ ছাউনির পাথর বেষ্টনী ও কাটাদার ঝোঁপের আড়াল থেকে এক নওজোয়ান তাঁবুগুলোর ভেতরে উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করছিলো। কখনো পায়ের পাতার ওপর দাঁড়িয়ে কখনো চাপা পায়ে পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে তাঁবুর ভেতরে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করছিলো সে। রাতের জমাট অন্ধকারে কিছুই তার চোখে পড়ছিলো না। পুরো তাবুপল্লী নীরব- শব্দহীন। এ ছিলো গভীর ঘুমের আলামত। কখনো ঘোড়ার আওয়াজ কখনো প্রহরীর বুটের খট খট খট আওয়াজ সেই নিঃশব্দ ভেঙ্গে দিচ্ছিলো। আবার সব নীরব হয়ে যাচ্ছিলো।