শত্রুতা আর চাটুকারিতার প্রতিযোগিতা ছিলো সরদার ও নেতৃস্থানীয়দের কাজ। কিন্তু এর শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছিলো সাধারণ লোকদের। পাঠান মুসলমানরা শিখদেরকে নিজেদের শাসক হিসেবে মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলো না কোন ক্রমেই। কিন্তু ঐক্য ও সঠিক নেতৃত্ব ছাড়া জুলুম অত্যাচার সহ্য করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিলো না।
এ অবস্থায় সে এলাকায় এলেন সায়্যিদ আহমদ শহীদ। তিনি দেখলেন, দুশমনের অনবরত জুলুম অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে লোকজন নিজেদের পরিবার পরিজন নিয়ে পাহাড়ে পাহাড়ে গিয়ে আত্মগোপন আর জাযাবরের জীবন যাপন করছে। লোকদেরকে তিনি শিখদের বিরুদ্ধে ঐক্যের পথে আসার দাওয়াত দিলেন। মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ পেলো। মসজিদ থেকে আবার কালেমা ও আযানে সুর মাধুরী ভেসে আসতে লাগলো।
***
হিম্মত খান যখন নওশহরা পৌঁছলো তখন তার অবস্থা মুমূর্ষ প্রায়। তার চেহারা মরা লাশের মতো ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণ করেছিলো। তাকে তখনই সায়্যিদ আহমদ শহীদের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। হিম্মত খনি হাঁপাতে হাঁপাতে ক্ষীণ কণ্ঠে জানালো রঞ্জিৎ শিং তার পয়গামের সঙ্গে ও তার সঙ্গে কেমন আচরণ করেছেন। সায়্যিদ আহমদ আগে হিম্মত খানের চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেন। তারপর ফৌজকে লড়াইয়ের জন্য তৈরী হওয়ার হুকুম দিলেন।
সেদিনই অটাকে বুধ শিং-এর ছাউনিতে লাহোর থেকে এক কাসেদ পৌঁছলো। পয়গামে বুধ শিংকে মহারাজা রঞ্জিৎ শিং হুকুম দিয়েছেন যে, সায়্যিদ আহমদ ও তার দলবলকে কোন সুযোগ না দিয়ে মৃত্যুর ঘাটিতে পৌঁছে দাও। আর যদি ওরা ফৌজের মতো প্রস্তুত হয়ে থাকে তাহলে হামলা করে খতম করে দাও ওদের।
অবশ্য এর আগে বুধ শিংও লাহোরে রঞ্জিৎ শিং-এর কাছে এক পয়গাম পাঠায়। লাহোরের কাসেদ বুধ শিং-এর কাছে পৌঁছার পরই বুধ শিং-এর কাসেদ লাহোরে রঞ্জিৎ শিং এর দরবারে পৌঁছে যায়।
পয়গামে লেখা ছিলো, সায়্যিদ আহমদ তার বাহিনী নিয়ে নওশহরা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। আমাদের ওয়াফাদার মুসলমান সরদাররা তার ব্যাপারে আমাকে যে খবর দিয়েছে এতে আমরা তাকে সাধারণ লোক বলে মনে করতে পারি না। আবার তাকে বড় কোন দরবেশ বা সুফীও বলতে পারবো না। আমাকে বলা হয়েছে, তিনি খুব যুদ্ধবাজ লোক, কাবুল কান্দাহার ও আশপাশের এলাকায় তিনি তার যুদ্ধ-নৈপুণ্যের চমৎকার ঝলক দেখিয়েছেন। গুপ্তচররা আমাকে জানিয়েছে, সায়্যিদ আহমদ আপনার দরবারে এক পয়গাম পাঠিয়েছে। যদি আপনি সে পয়গাম গ্রহণ করেন তাহলে তা শিখ সাম্রাজ্যের মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবে। আর যদি কাসেদকে প্রত্যাখ্যান করেন তাহলে মুসলমানরা সায়্যিদ আহমদের ঝাণ্ডা উঁচিয়ে আমাদের ওপর হামলা করে বসবে। পাঠানরাও সেই ঝাণ্ডার নিচে সমবেত হচ্ছে।
বুধ শিং পয়গামে জানালো, আঁকোড়ার রঈস আমীরখান আমাদের বিরুদ্ধে চলে গেছে। কিন্তু তার ভাই ফায়রুজখানের ছেলে খাসখান আবার আমীর খানের বিরোধী। তিনি আমাকে আকোড়া ডাকিয়েছেন। তিনি চাচ্ছেন। আমি আমার সেনাবাহিনী নিয়ে যেন আকোড়ার কাছে ছাউনি ফেলি এবং তার চাচা আমীর খান ও সায়্যিদ আহমদকে সেখানেই খতম করে দেই। এজন্য মহারাজার কাছে আমার আবেদন, অতি সত্বর যেন লাহোর থেকে সেনা সাহায্য পাঠানো হয়। কারণ, সায়্যিদ আহমদের সঙ্গে লড়াইয়ের সময় যদি আমাদের ওয়াফাদার কোন পাঠান সরদার মুসলমানদের সঙ্গে হাত মিলায় তাহলে আমরা বড় বিপদে পড়ে যাবো। তখন অতিরিক্ত সৈন্য না থাকলে আমরা খতম হয়ে যাবো।
মহারাজা রঞ্জিৎ শিং তখনই লাহোরের কেল্লাদার উধাম শিং ও আরেক কমাণ্ডার হরি শিংকে ডেকে আনলেন। তাদেরকে বুধ শিং-এর পয়গাম শুনিয়ে হুকুম দিলেন, তারা যেন অতি ক্ষিপ্রগতিতে প্রয়োজনীয় সৈন্য নিয়ে আকোড়া রওয়ানা হয়ে যান।
সায়্যিদ আহমদ যখন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতির হুকুম দিচ্ছিলেন বুধ শিং তখন আকোড়ার কাছে পৌঁছে গেছে। আর উধাম শিং ও হরি শিং তাদের বাহিনী নিয়ে অটাকের কাছের এক নদী অতিক্রম করছিলেন।
***
সায়্যিদ আহমদ শহীদের জন্য এজায়গাটি নতুন। লোকেরা তার আহ্বানে তার ঝাণ্ডাতলে সমবেত হচ্ছিলো। কিন্তু তিনি সতর্কও ছিলেন। কারণ, তিনি জানতেন, এদের মধ্যে সন্দেহভাজন ও গাদ্দার থাকতে পারে। যখন উভয় পক্ষ তীব্র লড়াইয়ে নেমে পড়বে তখন যেন এক মুসলমান আরেক মুসলমানের পিঠে খঞ্জর না চালায়- সায়্যিদ আহমদ এটাই চাচ্ছিলেন না। এজন্য নতুন লোকদের যাচাই বাছাইয়ে অনেক সময় চলে যায়।
ফৌজ প্রস্তুত মোটামুটি করে ফেললেন হযরত সায়্যিদ আহমদ। ঐতিহাসিকদের মতানুযায়ি এর সৈন্যসংখ্য ছিলো কেবল দেড় হাজার। শিখ সৈন্য ছিলো প্রায় দশ হাজার। এর মধ্যে উধাম শিং ও হরি শিং-এর সেনাদলও ছিলো।
সায়িদ আহমদ তার এই অল্প সংখ্যক সৈন্যদলকে যুদ্ধের সাধারণ নিয়ম অনুযায়ি চার ভাগে ভাগ করলেন। ডান ব্যুহের কমাণ্ডার ছিলেন মাওলানা মুহাম্মদ ইউসুফ (রা)। বাম ব্যুহের কমাণ্ডার সায়্যিদ মুহাম্মদ ইয়াকুব। তবে আকুড়ার যুদ্ধে সায়্যিদ ইয়াকুব থাকতে পারেননি। তার স্থলে নেতৃত্ব দেন সহকারী কমাণ্ডার শায়েখ বাতান। অগ্র বাহিনীর কমাণ্ডার ছিলেন মাওলানা মুহাম্মদ ইসমাঈল। আর চতুর্থ পদাতিক বাহিনীর কমাণ্ডার ছিলেন আল্লাহ বখশ খান। তিনি জমাদার আল্লাহ বখশ নামে পরিচিত ছিলেন।