তিনি নদীর এপারে- দেওয়ান উঠে জবাব দিলো তার সঙ্গে আছে সাত হাজার সৈন্য।
যথেষ্ট। উন্নত জাতের মোড়ায় করে এখনই কাসেদ পাঠিয়ে দাও। সে যাতে বুধ শিংকে এই পয়গাম দেয় যে, এখনই আকোড়া পৌঁছে যাও এবং সুবিধাজনক কোথাও ছাওনি ফেলল। তবে সৈন্যদের সব সময় প্রস্তুত রাখতে হবে। সেখানে আমাদের ওফাদার কোন মুসলমানকে পাঠিয়ে জেনে নিতে হবে সায়্যিদ আহমদের সৈন্যসংখ্যা কত? হামলার ব্যাপারে বুধ শিং নিজেই সিদ্ধান্ত নিবে এবং সায়্যিদ আহমদকে তার লশকরসহ খতম করে দেবে।
***
কাহেন শিং হিম্মত খানকে নিয়ে যাচ্ছিলো। সঙ্গে আছে আরো দুতিনজন সিপাহী। হিম্মতখান এখন নিরস্ত্র। হিম্মতখানের ওপর রাগে জ্বলে যাচ্ছিলো কাহেন শিং। কারণ, প্রথমে কেল্লায় প্রবেশের সময় তাকে বলার পরও তার তলোয়ার কাহেন শিং-এর কাছে হাওলা করেনি।
সে এক সিপাহীকে হুকুম দিলো, ওকে বড় ফটকের দিকে নিয়ে যাও। আর আরেকজন গিয়ে নাপিতকে নিয়ে এসো।
এসব কথায় হিম্মত খানের কোন ভাবান্তর হলো না। নির্বিকার-নিস্পৃহ মুখে শিখদের বেষ্টনীতে হাটছিলো হিম্মত খান। কাহেন শিংয়ের হয়রানির শেষ ছিল, হিম্মত খান কেন তার কাছে অনুনয়, বিনয় করছে না যে, তার চুল দাড়ি যেন না ফেলা হয়।
আরে এ দেখি মিটি মিটি হাসছেও। বেটা তো দেখি মহা শয়তান!
আরে ঐ মুসলে (মুসলমানের বাচ্চা)! কাহেন শিং হিম্মতখানের পেটে খোঁচা দিয়ে বললো– মহারাজার কাছে মাফ চাইলি না কেন? আমার পায়ে পড়ে যা। তোকে মাফ করে কেল্লার বাইরে সসম্মানে পাঠিয়ে দেবো।
হিম্মত খান হেসে বললো– আল্লাহর পথে আমাদের হাত পা কেটে গেলেও আফসোস করি না আমরা। আর আমার মাথার তুচ্ছ চুলের জন্য তোমার মতো এক গর্দভের কাছে মাফ চাইবো!
কাহেন শিং পেরেশান হয়ে গেলো। খুব কষ্ট করে নিজের হাত সংযত রাখলো। এই মুসলের যে সাহস। তারপর আবার দূত হয়ে এসেছে। একে কিছুই বলা যাচ্ছে না। রাখ শালা, নাপিত এনে নাপিতকে বলে দেবে। তোর মাথার চুল কাটার সময় যেন মাথাটা আঁচড়ে দেয়। এসব সে মনে মনে বললো, মুখে কিছুই বললো না।
কাহেন শিং ফটকের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো এবং এক সিপাহীকে নাপিত ডেকে আনার জন্য পাঠিয়ে দিলো। কেল্লার ফটক খুললো। ভেতরে দুজন সওয়ারী এসে ঘোড়া থেকে নেমে দাঁড়ালো। আর ঘোড়া দুটি ওখানেই দাঁড় করিয়ে রেখে কিছু জিজ্ঞেস করতে প্রহরীর দিকে এগিয়ে গেলো। ফটক খোলাই রইলো। কারণ, বাহির থেকে দুটি গরুর গাড়ি ভেতরের দিকে আসছিলো।
কাহেন শিং গরুর গাড়ির দিকে তাকিয়ে ছিলো। হিম্মত খান দেখলো, কাহেন শিং-এর মনোযোগ এখন অন্য দিকে। এই সুযোগ। মুহূর্তেরও কম সময়ে কাহেন শিং-এর চোয়ালে ও পেটে দুটি দশাসই ঘুসি পড়লো।
ওরে বাবারে বলে কাহেন শিং চিত হয়ে পড়ে গেলো সঙ্গে সঙ্গেই, আর হিম্মত খান তখন উঠে গিয়ে একটি ঘোড়ায় গিয়ে চড়লো এবং সজোরে ঘোড়ার পেটে খোঁচা দিলো। ঘোড়া এক লাফে ফটক পেরিয়ে ছুটতে শুরু করলো উধ্বশ্বাসে।
কাহেন শিং হাউমাউ করে উঠলো, কে কোথায় আছিসরে! ঐ সিপাহীরা! ঐ মুসলমানের বাচ্চা পালালো যে! সিপাহীরা দৌড়ে এসে এই দৃশ্য দেখে দ্বিধায় পড়ে গেলো, কাহেন শিং-এর এমন মজাদার তামাশা দেখবে, না ঘোড়ায় চড়ে মুসলমানের পিছু নেবে। কাহেন শিং-এর রক্ত চক্ষু দেখে তাড়াতাড়ি দুই সিপাহী ঘোড়ায় চড়ে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলো। কিন্তু হিম্মত খান ততক্ষণে অনেক দূরে চলে গেছে।
হিম্মতখান ঘোড়া ছুটাচ্ছিলো ঠিক; কিন্তু সে নিরাপদ ছিলো না। একে তো সে নিরস্ত্র ছিলো। দ্বিতীয়ত শিখদের কাছে দূর পাল্লার রাইফেল ছিলো। তার পিছু ধাওয়াকারীরা তাকে গুলি করে ফেলে দিতে পারে। যদিও সাধারণ সিপাহীদের কাছে তখন রাইফেল দেয়া হতো কম, তাই সে নিয়মিত রাস্তা থেকে সরে জঙ্গলের পথে ছুটতে লাগলো। রাবী পর্যন্ত পুরো এলাকাটাই ঘন জঙ্গলে ছাওয়া ছিলো তখন।
শীতের মৌসুম হওয়াতে যেখানে নদীর প্রান্ত চওড়া সেখানে পানির গভীরতা অনেক কম। হিম্মত খান দক্ষিণ দিক ঘুরে গিয়ে ঘোড়া নদীতে নামিয়ে দিলো। পানি ঘোড়ার হাঁটু পর্যন্তও পৌঁছছিলো না। নির্বিঘ্নে নদী পার হয়ে আবার উধ্বশ্বাসে ঘোড়া ছুটালো। তার সামনে এখন বড় লম্বা সফর।
***
অটাক থেকে পেশোয়ার পর্যন্ত পুরো এলাকায় ছিলো শিখদের শাসন ক্ষমতা। আসলে এ ছিলো জুলুম, অত্যাচার আর লুটপাটের রাজত্ব। শিখেরা তাদের এলাকাগুলো ত্যাগ করে ঠিকাদারির ভিত্তিতে কিছু বদ লোকদের দায়িত্ব দিয়ে রেখেছিলো। ঠিকাদাররা গরীব প্রজাদের কাছ থেকে অর্থকরি নিয়ে ফসল ফলাদিরও খাযনা আদায় করতে আর শিখদের ধনভাণ্ডার ভরে তুলতো। জায়গায় জায়গায় শিখ ফৌজ মোতায়েন থাকতো।
যেখানেই প্রজারা অতিষ্ঠ হয়ে বিদ্রোহ করতে চেষ্টা করতে শিখ ফৌজ তাদের ওপর টুটে পড়তো। কোন মুসলমানই সেখানে নিরাপদে থাকতে পারতো না। মুসলিম মেয়েদের আবরু ইজ্জত শিখদের কাছে যিম্মি হয়ে পড়েছিলো। মুরগির খোয়াড়ের মতো মেয়েদের ঘরের ভেতর ভরে রাখতে হতো। শিখ ফৌজের ঘোড়ার দানা পানির রহস্যও প্রজাদের ফসলি যমিন কেটে নিয়ে যাওয়া হতো। এজন্য লোকেরা আনাজ-তরকারি বাড়ির পেছনে গর্ত খুড়ে তাতে লুকিয়ে রাখতো।
পারস্পরিক হিংসা বিদ্বেষ শত্রুতা পোষণ ও ক্ষমতার লড়াই ইত্যাদি কারণে মুসলমানরা শিখ ও পাঠানদের হাতে নিগৃহীত হচ্ছিলো। এমনকি চারদিক থেকে কোণঠাসা হওয়ার পরও তারা ঐক্যের পথে অগ্রসর হয়নি। বরং একে অপরের ওপর ক্ষমতাবল প্রয়োগের জন্য শিখদের পা চাটা শুরু করে দিলো। শিখদের জন্য এছিলো না চাইতেই হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো। তারা পাঠান মুসলমানদের মধ্যে চোরা বিশ্বাস ঘাতক আর গাদ্দার তৈরী করতে পারলো খুব সহজে।