***
পরদিন সকালে মহারাজ রঞ্জিৎশিং তার শাহী সিংহাসনে বসেছিলেন। এ সিংহাসন ছিলো কোন মুসলমান বাদশাহর স্মৃতিখণ্ড। রঞ্জিৎশিং-এর চেহারা ফেরআউনি দম্ভে ফেটে পড়ছিলো। তার সামনে বসা ছিলো দরবারীরা। পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলো দুই মুহাফিজ। এক পাশে তার মহারানী। সবাই কেমন স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলো। কারণ, মহারাজাকে দেখে মনে হচ্ছিলো, তিনি কোন ব্যাপারে বেশ ক্ষুব্ধ। কুচকুচে চোখে তিনি দরজার দিকে বার বার তাকাচ্ছিলেন। যেন কারো অপেক্ষায় আছেন।
এসময় হিম্মত খান দরবারে প্রবেশ করলো। তার ডানে বামে বর্শা উঁচিয়ে দুই শিখও প্রবেশ করলো। হিম্মত খান রঞ্জিৎ শিং-এর সামনে গিয়ে দৃঢ় পায়ে দাঁড়িয়ে বললো- আসোলামু আলাইকুম।
মহারাজা মাথা ঝটকা দিয়ে দরবারী ও মুহাফিজদের ওপর চোখ ঘুরিয়ে গর্জে উঠলেন–
ওকে কি কেউ বলেনি যে, এটা মহারাজা রঞ্জিৎ শিং-এর দরবার। এখানে ঝুঁকে পড়ে সালাম করতে হয়?
মহারাজা! হিম্মত খান সোজা কণ্ঠে বললো–কেউ আমাকে বললেও আমি ঝুঁকে সালাম করতাম না। আমি এই পয়গাম নিয়েই এসেছি যে, কোন মানুষের এতটুকু অধিকার নেই যে, সে অন্য কোন মানুষকে তার সামনে ঝুঁকতে বাধ্য করবে। আল্লাহর বান্দা শুধু আল্লাহর সামনেই মাথা ঝোকায়।
সায়্যিদ আহমদের যে পয়গাম তুমি নিয়ে এসেছে সেটা শুনে তোমার ভাগ্যের ফয়সালা করবো- রঞ্জিৎ শিং বললেন তোমাকে যে এখানে পাঠায়েছে সে কি বলেনি যে, রঞ্জিৎ শিং-এর নাম শুনে ইংরেজ ও পাঠানরাও কেঁপে উঠে! তোমার বয়স তত কম। এজন্য যৌবনের আবেগ তোমাকে মুগ্ধ করে দিয়েছে তিনি ধমকে উঠলেন– শুনাও তোমার পয়গাম।
হিম্মত খান ভাঁজ করা একটা কাগজ খুললো এবং উঁচু আওয়াজে পড়তে শুরু করলো,
আল্লাহর নগণ্য বান্দা সায়্যিদ আহমদের পয়গাম, পাঞ্জাবের হাকিম মহারাজা রঞ্জিৎ শিং-এর নামে
আমি আপনার সামনে তিনটা দিক পেশ করছি। প্রথম হলো- ইসলাম কবুল করে নিন। সেক্ষেত্রে আমরা পরস্পর ভাই ভাই বনে যাবো। তবে এতে জোরজবরদস্তির কিছুই নেই। দ্বিতীয়তঃ ইসলাম গ্রহণ না করলে আমাদের আনুগত্য গ্রহণ করে নাও এবং জিযিয়া প্রদান করতে থাকো। সে ক্ষেত্রে আমরা যেমন আমাদের জান মালের হেফাজত করি তোমাদের জান মালেরও সেভাবে হেফাজত করবো।
তৃতীয়তঃ ওপরের দুটি প্রস্তাব মেনে না নিলে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হয়ে নাও। আর শুনে রাখো, পুরো ইয়াগিস্তান ও হিন্দুস্তানের প্রতিটি মুসলমান আমাদের সঙ্গে আছে। আর শহীদ হওয়া আমাদের কাছে যতটা প্রিয়, রক্তে স্নাত হওয়া আমাদের কাছে যতটা আকর্ষণীয়; তোমাদের কাছে শরাব আর রূপবতী নারীও এতটা প্রিয় নয় …
সায়্যিদ আহমদ
সালারে আলা
লশকরে মুহাজিদীন
মহারাজা রঞ্জিৎ শিং যেন আগুনের অঙ্গার হয়ে উঠলেন। মুহাফিজদের হাত চলে গেলো কোমরে বাঁধা তলোয়ারের ওপর। দরবারীরা দাঁড়িয়ে গেলো চরম উত্তেজিত হয়ে। হিম্মতখানের মুখে তার স্বভাবজাত হাসিটি ঝুলে রইলো। দরবারীদের নীরব হম্বিতম্বি তার গায়ে সামান্য আচরও কাটতে পারলো না। রঞ্জিৎ শিং দেখলেন, দরবারীদের চেহারা থমথম করছে। সবার হাত তলোয়ারের ওপর শক্ত হয়ে আছে। শুধু একজন শিখ-এর ব্যতিক্রম। যার চেহারা ছিলো ভাবলেশহীন। তিনি এমনভাবে বসেছিলেন যেন এর সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই। তিনি হলেন কেল্লাদার উধাম শিং।
এই ছেলে অনেক দূর থেকে এসেছে– রঞ্জিৎ শিং কর্কশ গলায় বললেন এজন্য আমি ওর মার প্রতি রহম করছি। তাকে মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই দেয়া হবে। তবে তার মাথার চুল, দাড়ি, গোঁফ কামিয়ে তাকে লাহোর থেকে বের করে দাও।
কাহেন শিং সঙ্গে সঙ্গে পেছন থেকে হিম্মতখানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। কোষ থেকে তলোয়ারটি ছিনিয়ে নিলো। পাঁচ ছয়জন মুহাফিজ হিম্মতখানকে ঘেরাও করে ধাক্কাতে ধাক্কাতে দরবার থেকে বের করে নিয়ে গেলো।
সায়্যিদ আহমদ! রঞ্জিৎ শিং বিদ্রূপ করে বললেন- আহ … হাহ! সায়্যিদ আহমদ, … এই জাযাবর মুসলমানরা বরবাদ হয়ে গেলো। কিন্তু এখনো তাদের মাথা থেকে হিন্দুস্তানের বাদশাহীর ভূত নামলো না। মোল্লাদের মতো ওয়াজ করনেওয়ালা সায়্যিদ আহমদ শিখ রাজাদের সঙ্গে লড়তে এসেছে। ওকে কেউ কি বলেনি যে, এখন রাজত্ব করবে শুধু শিখ রাজারা?
মহারাজা! উধাম শিং গম্ভীর গলায় বললেন–না দেখে যাচাই না করে দুশমনকে দুর্বল মনে করা ঠিক নয়। কাসেদ এসেছে নও শহরা থেকে। এর অর্থ হলো, মুসলমান লশকর নও শহরা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। সায়্যিদ আহমদ সম্ভবত ঠিকই লিখেছেন যে, পুরো ইয়াগিস্তান তার সঙ্গে আছে …
আমি এও জানতে পেরেছি, হিন্দুস্তান ও পাঞ্জাবের মুসলমানরাও নও শহরা ও পেশোয়ার যাচ্ছে। সায়্যিদ আহমদ তাদের মধ্যে নতুন কোন প্রাণের সঞ্চার করেছেন যেন। ওখানে গিয়ে আমাদের অবরোধের মতো অবস্থান নেয়া উচিত। না হয় শিখ রাজ্য বেশি দিন দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। আর আমাদের উচিত মুসলমানদেরকে আকোড়া ও নও শহরার পাহাড়ে লড়ানো। যদি ওরা লাহোরের ময়দানে আসার সুযোগ পায়, লড়াই তাদের জন্য সহজ হয়ে উঠবে এবং আমাদের জন্য ওরা কঠিন প্রতিপক্ষ হয়ে উঠবে। যা করার এখনই করতে হবে।
বুধ শিং এখন কোথায় আছে? রঞ্জিৎ শিং জিজ্ঞেস করলেন- তার সঙ্গের সৈন্য সংখ্যা কত?