পেছনে উধাম শিংকে দেখে চমকে উঠলো। কখন উধাম শিং এসেছেন সেটা সে টের পায়নি। উধাম শিং হিম্মত খানের খাটের ওপর বসে পড়লেন।
আমি তোমাদের সালারে আলা সায়্যিদ আহমদ সম্পর্কে জানতে চাই। উধাম শিং বললেন- আমি তার সম্পর্কে সামান্যই শুনেছি।
আপনার এ আশা করা উচিত হবে না যে, যা বলা উচিত নয় তা আমি আপনাকে বলে দেবো- হিম্মত খান বললো কিছুটা শক্ত কণ্ঠে আপনি আমাকে ইযযত করেছেন ঠিক, কিন্তু এজন্য আপনাকে আমি বন্ধু বলে গ্রহণ করতে পারি না। আপনাকে আমি এটা বলতে পারবো না যে, আমাদের সৈন্যসংখ্যা কত? আমাদের অস্ত্র কি কিংবা আমাদের লড়াইয়ের কৌশলই বা কি? শুধু ব্যক্তি সায়্যিদ আহমদ সম্পর্কে আপনাকে আমি বলতে পারবো। তিনি কে? এবং কি তার মিশন।
আমি এটাই জানতে চাই- উধাম শিং সামান্য হেসে বললেন।
আমার কথা হয়তো আপনার কাছে ভালো লাগবে না– হিম্মত খান বলে। গেলো এটা মাযহাব আর ধর্মের ব্যাপার। প্রত্যেকেই তার ধর্মকে সত্য বলে মনে করে। তারপরও আপনি যা জানতে চান তা আমি সংক্ষেপে বলছি …
উনার নাম সায়্যিদ আহমদ। হিন্দুস্তানের বেরলভী শহরের লোক। আল্লাহ তাআলা তাকে অন্তরলোকের আলো দান করেছেন। দিয়েছেন এক মঞ্জিলের রাহনুমা। যা হক ও সত্যের মঞ্জিল। সায়্যিদ আহমদ অনেক বড় বিদ্বান-আলেম। কিন্তু তিনি কামরায় বসে আল্লাহ আল্লাহ করা আর মিম্বারে উঠে ওয়াজ নসীহতকারী আলেম নয়। তিনি আল্লাহর পথে সংগ্রামের শিক্ষা দেন। মুসলমানের জন্য আল্লাহর পথে সংগ্রাম অন্যতম এক ইবাদত…।
হিন্দুস্তান ইসলামী রাষ্ট্র। কিন্তু মুসলিম রাজা বাদশাহরা যখন আল্লাহর পথ থেকে সরে গেছে তখন তো দেখেছেনই ইসলামী ঝাণ্ডাও মুখ থুবড়ে পড়েছে। আর সমুদ্রের ওপার থেকে ফিরিঙ্গিরা এসে এদেশ দখল করেছে। সায়্যিদ আহমদ আমাদের সবক দিয়েছেন যে, কুরআনের শিক্ষা মতে মুসলমান কারো গোলাম হতে পারে না। কারণ, গোলামি মানুষের ভেতরের সব কল্যাণবোধও স্বকীয়তাবোধ নষ্ট করে দেয়। সায়্যিদ আহমদ তাই হিন্দুস্তানে আল্লাহর হুকুম কায়েম করতে চান। গোলামি করতে হলে একমাত্র আল্লাহর গোলামি করতে হবে। কোন মানুষের গোলামি করা যাবে না …
বর্তমানে দেশের যে অবস্থা তাতে লড়াই আর জিহাদ ফরজ হয়ে গেছে। এজন্যই তিনি জিহাদের শিক্ষা দেন। কাফেরদেরকে প্রথমে তিনি সত্যের পথে দাওয়াত দেন। তিনি বলেন, মানুষের ওপর মানুষের আইন চলবে না, চলবে আল্লাহর আইন। কুরআনে যা আছে তাই বলেন আমাদের সালারে আলা। তিনি গ্রামের পর গ্রাম শহরের পর শহর ঘুরে এসেছেন। সর্বপ্রথম তিনি পথহারা মুসলমানদেরকে আল্লাহর পথে দাওয়াত দেন। তিনি বলেন, কুফুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা অনেক বড় ইবাদত। আর আল্লাহর পথে তলোয়ার চালনা আর। তীরন্দাযী ছাড়া দীনী ইলম- ইসলামের শিক্ষা পূর্ণ হতে পারে না।…
তিনি যে দিকেই যান সেখানকার মুসলমানরা তার শিষ্য বনে যান। তার বলার সুরে এমন এক তন্ময়তা আছে যে, কোন মুসলমান তাকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে না। তার আওয়াজে যেন আল্লাহর গায়েবী আওয়াজ আছে। অসংখ্য বিধর্মীও তার হাতে বায়আত হয়েছে এবং মুসলমান হয়ে গেছে …।
আমি খুব শিক্ষিত ছেলে নই। অতি সাধারণ এক লোক। আমি তাঁর মতো বলতে ও পারবো না এবং আমার ভাষায় আপনি সেই মুগ্ধকর স্বাদও পাবেন না। আপনি কখনো তার কথা শুনলে অজান্তেই বলে উঠবেন। এটা মানুষ নয় খোদাপাক যেন বলছেন। তখন আপনিও আমার মতো তীর বৃষ্টি আর দুশমনের তলোয়ারের ছায়ায় নিশ্চিন্ত মনে নামায পড়তে পারবেন। যদি জিজ্ঞেস করেন আমাদের লড়াইয়ের কৌশল কি? এর জবাবে আমি শুধু এতটুকু বলবো যে, আমরা একমাত্র আল্লাহর ওপর ভরসা করে লড়াই করি।
শিখেরা সুসংগঠিত কোন জাতি ছিলো না। গোত্র আকারে এরা অস্তিত্বমান হয়। যাদের ইতিহাসে শাসন-ক্ষমতা আর লড়াই-যুদ্ধের নাম নিশানাও ছিলো না। এজন্য রণাঙ্গনের ব্যাপারে তাদের অভিজ্ঞতা একেবারেই ছিলো না। তবে ব্যক্তিগতভাবে এরা লড়তে জানতো। কারণ, তাদের পেশা ছিলো ডাকাতি আর রাহাজানি। দলবদ্ধ হয়ে এরা ছিনতাই রাহাজানি করতো।
মোগল সাম্রাজ্যের পতনের পর হিন্দুস্তানের অবস্থা বড়ই শোচনীয় হয়ে উঠে।
ইংরেজরা পুরো ভারতবর্ষ গ্রাস করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। কেন্দ্রীয় কোন শাসন ক্ষমতা ছিলো না। নৈরাজ্য আর বিশৃংখলাই ছিলো আসল হুকুমত। এই নৈরাজ্যজনক অবস্থা থেকে ফায়দা উঠায় শিখেরা। তারা পাঞ্জাব দখল করে নেয়। এদের রাজত্বের সময়সীমা ছিলো চল্লিশ বছরের। তবে এর মধ্যে তারা যুদ্ধ বিগ্রহহীন নিরাপদ সময় খুব একটা উপভোগ করতে পারেনি। ইংরেজ কিংবা মুসলমানদের সঙ্গে তাদের লড়াই লেগেই থাকতো। এমনকি হিন্দুদের সঙ্গেও তাদের লড়াই হয়।
মুসলমানদেরকে এ সময় হযরত সায়্যিদ আহমদ শহীদ (র.) তাহরীকে মুজাহিদীন-এর প্লাটফর্মে সমবেত করার চেষ্টা করেন।
শিখদের মধ্যে যদিও বোধ বুদ্ধি ও দূরদর্শিতা কম ছিলো এবং উগ্রতা আর অবাধ্যতাই ছিলো বেশি; কিন্তু লাহোরের কেল্লাদার উধাম শিং রাশভারী লোক ছিলেন। তিনি ভাবনা চিন্তা করতে জানতেন। তিনি কাসেদের কাছ থেকে সায়্যিদ আহমদের চেতনা-দর্শন শুনে অন্যদের মতো ঠাট্টা বা বিদ্রূপ করলেন না। নীরবে মেহমানখানা থেকে বেরিয়ে গেলেন। তার আনত মাথা ও চলার ভঙ্গি বলে দিচ্ছিলো, তিনি গভীর চিন্তায় ডুবে গেছেন।