অনেকক্ষণ বিশ্রাম করে তীর থেকে অদূরে শহরের দিকে তারা অগ্রসর হল। পৌঁছল শহরে। এখানকার লোকগুলো তাদের দিকে তাকাচ্ছিল চিড়িয়াখানার আজব চিড়িয়া দেখার মতো। বেশভূষায় এরা এ শহরে নবাগত, তাই দেখছিল সবাই। অনুন্নত কাপড়ে আচ্ছাদিত আল হাকামের স্ত্রী। তার রূপই ছিল এদের দৃষ্টি কাড়ার বড় কারণ। স্বামী-স্ত্রী হাঁটছিল লক্ষ্যহীন গন্তব্যে। গলির যুবক পুরুষেরা রূপসী এই যুবতী ও শিশুসহ আল হাকামের দিকে তাকিয়ে ঈর্ষান্বিত হলি ক্ষণিকেই। চোখ ফেরাতে পারছিল না আল হাকামের স্ত্রী থেকে অনেক কামুক পুরুষ।
আল হাকামের স্ত্রীর সৌন্দর্য তাৎক্ষণিক তাদের ফায়দা দিল। এক ধনাঢ্য ব্যক্তির আস্তাবলের নওকরী পেয়ে গেল আল হাকাম। আস্তাবলের পাশেই একটি বুপড়িতে থাকতে দিল তাদের। স্ত্রী ঝুপড়িতেই কোলের ছেলে নিয়ে সংসারের গোড়াপত্তন করল।
বেশি দিন আর ঝুপড়িতে থাকা হলো না হাকাম পত্নীর। ডাক এলো মহল থেকে। তাকে নিয়োগ দেয়া হলো মহলের পরিচারিকার পদে। পরদিন যখন আমীরের মহলে হাকামের স্ত্রী কাজের জন্য উপস্থিত হলো, তাকে এগিয়ে এসে নিয়ে গেল এক বয়স্কা মহিলা। মহিলা তাকে গোসল করাল এবং খুব দামী জরিদার শাহী জামা পরিয়ে দিল। জামার নকশা-ই বলে দেয় এটা মামুলী পরিধেয় বস্ত্র নয়। এটা এমনভাবে ডিজাইন করা আর কাপড় এত পাতলা যে, শরীরের ভাঁজগুলো দেখা যায়। হাতে বাজু, গলা, বুকের অর্ধাংশ খোলা থাকে। হাকাম পত্নীর এসব কাপড় পরতে ভালো লাগছিল না। যাযাবর হলেও শরীর ঢেকে রাখতে অভ্যস্ত ছিল হাকামের স্ত্রী।
মহিলাটা তাকে বোঝাল, আমাদের মালিক নোক্সামি পছন্দ করেন না, তিনি পরিপাটি দেখতে অভ্যস্ত। এগুলোতে সেজে থাকলে তোমাকে দেখে খুশি হবেন। কাপড় গায়ে জড়িয়ে তাকে একটি আরশীর সামনে নেয়া হলো। আরশীতে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে নিজেই নিজের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে গেল। নিজেকে শাহজাদী মনে হতে লাগল। তার চুল আঁচড়ে দেয়া হল। ছড়িয়ে দেয়া হল পিঠের উপর। মহিলা তার সারা শরীরে মনমাতানো সুগন্ধি ছিটিয়ে দিল। নতুন এই সাজে আল হমের স্ত্রীকে পরীর মতো মনে হচ্ছিল।
দেরী না করে মহিলা তাকে নিয়ে গেল মনিবের সামনে। বিশাল এক সুসজ্জিত ঘর। মেঝেতে এমন কার্পেট, সাজানো ঘর, ঝলমলে আলো দেখেনি জীবনে যাযাবর যুবতী। আমীর উমারার জীবন-জীবিকার গল্পেই যা শুনেছে।
আল হাকামের স্ত্রীকে দেখে আমীরের দৃষ্টি ওর শরীরেই আটকে রইল। ভূতে পাওয়ার মতো ওর দিকে তাকিয়ে রইল দীর্ঘক্ষণ। জ্বলজ্বল করে উঠল তার চোখ। নেশাগ্রস্তের মতো কণ্ঠে মহিলাকে বলল, তুমি যাও! মহিলা চলে গেল।
আমীর আল হাকামের স্ত্রীকে কাছে ডাকল। বসতে বলল। কিন্তু যুবতী বসল না। আমীর দাঁড়িয়ে তার দুই বাজু ধরে নিজের দিকে আকর্ষণ করল, কিন্তু যুবতী মোচড় দিয়ে দূরে সরে গেল। তার বুঝতে বাকি রইল না, পরিচারিকার কাজের কথা বলে আসলে তাকে কেন আমীরের কাছে নিয়ে আসা হয়েছে।
শুনেছি তুমি যাযাবর মেয়ে। এখন তো দেখছি, তুমি নিজেকে শাহজাদী মনে করছো। দেখ আমি তোমার উপর কোন হুকুম চালাব না। তোমাকে উপযুক্ত এনাম দিব, আমার হেরেমে শাহজাদী হয়ে থাকবে।
একথা শুনে যুবতী দরজার কাছে সরে গেল। আমীরের চেহারা আগুনের মতো লাল হয়ে উঠল।
“আমি সোনার দিনার ভর্তি থলিতে লাথি মেরে এখানে ফেরার হয়েছি। নিজেকে নিলামে বিক্রি করতে ইচ্ছুক নই। তা না হলে বিয়ে করে স্বামী নিয়ে নদী সাঁতরে কেন পালিয়ে এসেছি নিজের গোত্র ছেড়ে। আমার স্বামীকে তোমার দশ মেয়ে দিলেও আমি তোমার কাছে যেতে পারব না।”
“স্বামী থেকে হাত ধুয়ে ফেল লাড়কী। বাচ্চার মমত্বও ভুলে যাও। এসো, আমার কাছে এসো।”
তুফানের মতো দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে এলো হাকামের স্ত্রী। সোজা চলে গেল সেই ঘরে যেখানে ওর পরিধেয় কাপড়গুলো ফেলে এসেছিল।
রাগে গর্জে উঠল আমীর। ডাকল বয়স্ক মহিলাকে। দৌড়ে এলো বয়স্কা মহিলা, আরো এক সেবিকা এবং হেরেমের দু’ নারী। তারা মনিবের রাগত চেহারা দেখে হতভম্ব।
“হারামজাদী! শরমালে ভিন্ন কথা ছিল, কিন্তু ও আমাকে অপমান করে বেরিয়ে গেল।”
আমরা ওকে চুল ধরে নিয়ে আসছি। বলল এক খাদেমা।
না। এই যাযাবর ভিখারিনীকে আমি এমন কঠিন শাস্তি দেবো, যা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বহুদিন। আমীর দু’জন বিশেষ প্রহরীকে ডেকে বলল, আমার আস্তাবলের পাশের ঝুপড়িতে যে হতভাগা থাকে ওকে আজ রাতে হত্যা করে ওর স্ত্রীকে আমার কাছে নিয়ে আসবে, আর ওদের কোলের বাচ্চাটিকে বিক্রি করে দেবে।’
হেরেমের মেয়েরা পরস্পর চোখাচোখি করল। উভয়েই নির্বিকার। মনিব ক্ষোভে জ্বলছে।
“কোন শাহজাদী হলে না হয় এমন দেমাগ সহ্য করা যেতো। হতভাগী এক যাযাবর ভিখারিনীর এতো স্পর্ধা যাও, সবাই এখান থেকে চলে যাও।”
গভীর রাতে আল হাকামকে হত্যা করে তার স্ত্রীকে অপহরণ করার চক্রান্ত করা হলো। বেলা অস্ত যাওয়ার পর আল হাকাম তার ঝুপড়িতে এলো। স্ত্রী নিজের কাপড়েই। আমীরের রক্ষিতা যে পোশাক তাকে পরিয়েছিল তা খুলে ছুঁড়ে ফেলে এসেছিল সে।
ভাবছিল আজকে তার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া চক্রান্তের কথা তার স্বামীকে বলবে কি-না। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত সে নিয়ে ফেলেছে, আর এক মুহূর্তও এখানে থাকবে না। স্বামীকে নানাভাবে সে এখানে না থাকার বিষয়টি বোঝাতে পেরেছিল। কিন্তু ঘূর্ণাক্ষরেও তার এই ব্যাপারটি জানা ছিল না যে, আজই সে স্বামীকে জীবিত দেখছে, তার কলিজার টুকরো সন্তানকে তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়ার চক্রান্ত করা হয়েছে, তার ইজ্জত-সম্ভ্রম লুটে নেয়ার ষড়যন্ত্র পাকা হয়ে গেছে।