“তোমার মধ্যে তোমার গোত্রের রীতিনীতি বিরোধী স্বভাব কি করে এলো? যাযাবরদের মেয়েরা তো বিক্রি হতে অপছন্দ করে না।”
“জানি না আমার মধ্যে কীভাবে এ আকাক্ষা জন্ম নিলো যে, তুমি বিয়ে করে একজন পুরুষের স্ত্রী হিসেবে থাকবে।’ একথা আমাকে কেউ শিখিয়ে দেয়নি। আমার কল্পনাই আমার কানে বাজতো। হৃদয়ের একথা শুনতে শুনতে আমার দৃঢ় বিশ্বাস হলো, আমার আকাক্ষা সফল হবে।”
“তোমার অনাগত সন্তান বড় হয়ে বিখ্যাত হবে এমন অলীক কল্পনা মন থেকে দূর কর। এ স্বপ্ন তোমার মাথা খারাপ করে ফেলবে।” বলল আল হাকাম।
বংশ ধ্বংসের ভয় ও রাতের প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি, আকাশের গর্জন কাকতালীয় । ব্যাপার হতে পারে, কিন্তু দুই অশ্বারোহী দিনার ভর্তি থলে নিয়ে এসে ঠিকই কিশোরীর জন্য সাক্ষাত আপদ হিসেবেই আবির্ভূত হয়েছিল। আকস্মিক এই ঝড়-বৃষ্টি, আকাশের গর্জন অসহায়-অবলা এক কিশোরীর সম্পর্ক থাকুক বা না থাকুক কিশোরীর মান রক্ষায় এগুলো বেশ কাজ করেছে। আল হাকাম বাস্তববাদী মানুষ। সে এগুলোকে অলৌকিক কিছু মনে করেনি, ভিত্তিহীনও ভাবেনি। তবে যে বিষয়টি তাকে নাড়া দিয়েছে তা হলো, এ কিশোরী সত্যিকার অর্থে পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র মনের অধিকারিণী। ওর দৈহিক রূপলাবণ্যের চেয়েও আত্মিক সৌন্দর্য অনেক বেশি।
বিয়ে করে আল হাকামও যাযাবরদের সাথে মিশে গেল। কেটে গেল অনেক দিন। দু’বছরের মাথায় তাদের একটি ছেলে জন্ম নিল। আল হাকাম ছেলের নাম রাখল “সুবক্তগীন”। ছেলে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তার স্ত্রীর স্বপ্ন আরো দৃঢ় হলো। তার বিশ্বাস, এই ছেলে বিখ্যাত হবে। আল হাকাম তার স্ত্রীর কথা শুনে সময় সময় হাসতো। একদিন স্ত্রী আল হাকামকে জিজ্ঞেস করল, “এই ছিন্নমূল যাযাবর জীবন কি এখন আর আপনার বিরক্তিকর লাগে না?”
“আমার মধ্যে এ জীবন নিয়ে এখন আর কোন অস্বস্তি নেই। কিন্তু আমার ছেলেকে আমি এই জংলী জীবন থেকে দূরে নিয়ে যাবো। জীবন নিয়ে পালিয়ে বেড়ানো কি কোন সভ্য মানুষের জীবন হতে পারে?” বলল আল হাকাম।
“আমার বিশ্বাস ছিল, এ আশাও এখন আমার পূর্ণ হবে যে, আমার কোলের সন্তান লেখাপড়া শেখার মতো জায়গায় পৌঁছতে পারবে। অবশ্য আমি তোমার মতো দুনিয়ার কোথায় কি আছে জানি না।” বলল হাকামের স্ত্রী।
“কোন আমীর-শরীফ লোকের ঘরে মজদুরী তো মিলতেই পারে। খোদার জগত তো আর ছোট্ট নয়। যে আল্লাহ্ তোমাকে বাচ্চা দিয়েছেন তিনি তার রিযিকের ব্যবস্থা করেই রেখেছেন।” বলল আল হাকাম।
“লুকিয়ে ছাপিয়ে আমাদের এখান থেকে পালাতে হবে।” বলল আল হাকামের স্ত্রী। এই গোত্রের লোকেরা তোমাকে এমনিতে যেতে দেবে না। কারণ, তুমি টাকা ছাড়াই বিয়ে করেছো, এর বিনিময়ে তোমাকে পেয়ে ওদের শক্তি বেড়েছিল অনেক। আমি তোমাকে একটা ফন্দির কথা বলি, “আগামীকাল আমরা লাকড়ি কুড়াতে বের হয়ে আর ফিরে আসবো না।”
স্ত্রীর কথামতো পরদিন তারা গোত্রের অন্যদের মত কাঠ কুড়ানোর কথা বলে ছেলেকে সাথে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। ছেলের বয়স তখন ছয়। মাস মাত্র।
দুপুর গড়িয়ে গেল। তখনও তাদের তাঁবুতে ফেরার নাম নেই। বুড়োদের সন্দেহ হলো। শক্ত সামর্থ্য দুই ব্যক্তি ঘোড়া নিয়ে বেরিয়ে পড়ল ওদের খোঁজে। বুড়োদের সন্দেহ ছিল বিবিধ। আল হাকামের পালিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তো ছিলই তার চেয়ে বেশি ছিল সুন্দরী ওই যুবতী অপহরণের শিকার হওয়ার। তারা আশঙ্কা করছিল, না জানি কোন ডাকাতের পাল্লায় পড়ল কিনা ওরা। দৈবাৎ এক পথিক সন্ধানী-অশ্বারোহীদের বললো, এক যুবককে সুন্দরী যুবতী ও একটি শিশুকে নিয়ে সে নদীর দিকে যেতে দেখেছে।
সন্ধানকারীরা পথিকের কথা মতো ওদিকেই ঘোড়া হাকিয়ে দিল, তাদের সন্দেহ ছিল, আল হাকাম হয়তো তাদের মেয়েটিকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার চেষ্টা করছে। আল হাকাম ও তার স্ত্রী হেঁটে যাচ্ছিল। পথ ছিল অসমতল এবড়ো থেবড়ো। তারা যে পথে যাচ্ছিল তার পাশেই ছিল নদী। হঠাৎ পিছন থেকে ঘোড়ার আওয়াজ শোনা গেল। পিছন ফিরে দেখলো, দুই অশ্বারোহী তাদের দিকেই ধেয়ে আসছে। একটু অগ্রসর হলেই আল হাকাম তাদের চিনে ফেলল। আরোহীরা খাপ থেকে তরবারী বের করে আক্রমণোদ্যত হয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। আল হাকাম নিরস্ত্র ছিল। এটা ছিল আল হাকামের মারাত্মক ভুল যে সে কোন অস্ত্র সাথে রাখেনি। সে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। হতাশার দৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে তাকাল।
“নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়।” বলল তার স্ত্রী।
“অনেক গভীর তীব্র স্রোত, ওরা তো ঘোড়া নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দেবে।” বললো আল হাকাম।
“আমি তোমাকে বলছি, তুমি নদীতে ঝাঁপ দাও! বাচ্চাকে তুমি বাঁচাও, ওকে ছাড়া আমি সাঁতরাতে পারব।” স্ত্রী কথাগুলো এমন দৃঢ় প্রত্যয়ের সুরে বলল যেন সে আল্লাহর নির্দেশে বলছে।
“বেশি কিছু চিন্তা-ভাবনার অবকাশ ছিল না। আল হাকাম স্ত্রীর কোল থেকে সুবক্তগীনকে নিয়ে এক হাতে ওকে ধরে নদীতে ঝাঁপ দিল। এক হাতে সঁতরাচ্ছিল আল হাকাম। স্ত্রীও তার সাথে সাথেই সাঁতরে ওর পাশাপাশি থাকতে চেষ্টা করছিল। নদী ওই দিকেই প্রবাহিত হচ্ছিল যে দিকে যাত্রা করেছিল তারা। সন্ধানী অশ্বারোহীরা এদের নদীতে ঝাঁপ দিতে দেখে তীরে ঘোড়া থামাল এবং চিৎকার করে ওদের হুশিয়ার করল। কিন্তু ততক্ষণে ওরা নদীর মাঝামাঝি চলে গেছে। ভাগ্যক্রমে নদীর ওপারে গভীরতা কম ছিল। এক পা আর এক হাতে সঁতরাতে সাঁতরাতে অবশ হয়ে আসছিল আল হাকামের হাত-পা। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে সে নিজেকে ও শিশুকে পানির উপর ভাসিয়ে রাখছিল। এক পর্যায়ে অবস্থা এমন হলো যে, আল হাকাম আর সাঁতরাতে পারছিল না। তার পা সোজা পানির তলদেশে তলিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু সে প্রাণপণ বাচ্চাকে ঊর্ধ্বে তুলে রাখতে শরীরের শেষ শক্তিটুকু প্রয়োগ করলেও বাচ্চা আর নিজের জীবনের আশঙ্কা দেখা দিল। প্রায় তলিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো আল হাকামের। হঠাৎ তার পা মাটি স্পর্শ করল। সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। শুকুর আল্লাহর। নদীর কূল যেন তাদের বাঁচাতে এগিয়ে এলো। গলা পানিতে দাঁড়িয়ে স্ত্রীকে দেখলো সে। এখনো অনেক দূরে। তলিয়ে যাচ্ছে, আবার হাত-পা ছুঁড়ে এগুতে চাচ্ছে। চিৎকার করে বলল আল হাকাম, “দাঁড়িয়ে যাও ওখানে, ওখানে পানি কম।” কিন্তু ওর কানে যাচ্ছিল না সেই ডাক। আল হাকামও দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না, স্রোতের তীব্রতায় শক্ত করে দাঁড়ানো অসম্ভব। আল হাকাম তবুও আগালো স্ত্রীর দিকে। ধরে ফেলল ওর চুলে, টান দিয়ে সোজা করতেই স্ত্রীর পা মাটি স্পর্শ করল। সেও দাঁড়াল। স্বপ্নে দেখার মতো তাকাল বাচ্চা ও হাকামের দিকে। যেন মরতে মরতে বেঁচে গেল। মুখে কোন কথা উচ্চারণ করা সম্ভব হলো না। নদীর এপারে এসে গেছে তারা। এখন আর পাকড়াও হবার ভয় নেই। পানি থেকে তীরে এসে হাত-পা ছড়িয়ে বসে পড়ল স্ত্রী। আল হাকামও ছেলেটিকে কোলে শুইয়ে দিয়ে পা ছড়িয়ে বসল। ক্লান্ত, ভীষণ ক্লান্ত উভয়ে। শরীরে হাঁটার মতো শক্তি তাদের নেই।