রাত পোহাল। সবাই তখনও কাঁপছে। ভয়ে-আতঙ্কে সবাই এক জায়গায় জড়ো হয়েছে, কারো মুখে রা’ করার হিম্মতটুকু ছিল না। এই মেয়েটি আমাদেরকে চোখ উল্টে উল্টে ভৎর্সনার দৃষ্টিতে তাকিয়ে একটু দূরে সরে গেল। আমরাও লজ্জায় ওর দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছিলাম না। ওর হুঁশিয়ারী আমাদের কানে বাজছিলো : আমার উদরে কখনও হারাম সন্তান আসবে না, এর অপচেষ্টা করলে তোমরা সব ধ্বংস হয়ে যাবে। তখনও সে কুরআন শরীফ বুকে চেপে রেখেছিল আর অনুচ্চস্বরে কি যেন পড়ছিলো…।
আমরা ছেঁড়া-ফাড়া তাঁবুগুলো আর বিক্ষিপ্ত জিনিসপত্র একত্র করে ওকানোর ব্যবস্থা করলাম। বেলা চড়লে দুই অশ্বারোহী এসে হাজির হলো। তারা আমাদের প্রত্যাশিত স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে এলো। মুদ্রা ভর্তি থলে আমাদের পায়ের কাছে ছুঁড়ে মেরে বলল, “এই দিনারগুলো নাও আর মেয়েটিকে আমাদের হাতে তুলে দাও।”
আমি থলেটি তুলে এক অশ্বারোহীর হাতে দিয়ে বললাম, “তোমরা দিনার নিয়ে চলে যাও, আমি মেয়ে দিতে পারব না।”
অপর আরোহী আরো দুটি দিনার আমার পায়ের দিকে ছুঁড়ে বলল, “আরও চাইলে বল। যা চাও তাই দেবো তবুও মেয়েটিকে আমাদের দিতেই হবে।” কিন্তু মেয়েকে তাদের হাতে না দিয়ে ফিরিয়ে দিলাম।
“ও কার মেয়ে?”
“মেয়েটি আমার ভাতিজী, এতীম।” শ্বেতশ্মশ্রুধারী বুড়ো বলল।
আল হাকাম দুহাত দেখিয়ে বলল, আমার হাত খালি, মেয়ের দাম দেয়ার মতো কিছুই আমার হাতে নেই। আপনারা কি আল্লাহর ওয়াস্তে বিনা দামে আমাকে মেয়ে দেবেন?
আমাদের সাথে তোমাকে থাকতে হবে। প্রতি রাতেই ডাকাতের আক্রমণাশঙ্কা থাকে। তুমি থাকলে পুরুষের সংখ্যা বাড়বে। পুরুষের সংখ্যা বেশি থাকলে ভয় কম থাকে। এই মেয়েটাকে যে কত লুকিয়ে-ছাপিয়ে এ পর্যন্ত রেখেছি তা বলে শেষ করা যাবে না। ভারী গলায় বলল পক্ককেশী বুড়ো।
বুডোর প্রস্তাবে সম্মত হলো আল হাকাম। সেই মেয়েটির সাথে বিয়ে হয়ে গেল আল হাকামের। বেদুইন যাযাবরদের বিয়ে। কোন আয়োজন প্রস্তুতি নেই। বড়দের সিদ্ধান্ত আর পাত্রের আগ্রহ এই যথেষ্ট। অধিকাংশ যাযাবর মেয়েদের সতীচ্ছেদ ঘটে বিয়ে ছাড়াই। হয়তো ডাকাতের হাতে, না হয় কোন বেশি দামের ক্রেতার শয্যায়। বিবাহকালীন ধুমধাম আহার আয়োজনও ওদের সমাজে নেই।
“আমার জীবন ও স্বাধীনতার বিনিময়ে তোমাকে পেলাম। তোমাকে দাসী করার পথ বন্ধ করে নিজে গোলাম হয়ে গেলাম। প্রথম রাতেই স্ত্রীকে বলল আল হাকাম।
“আমি বন্দীদশায় থাকার মানুষ নই। তোমার প্রেমে দিওয়ানা হয়ে গেছি একথাও ঠিক নয়। তোমার চাচা তোমার আদি-অন্ত সব কাহিনী আমাকে শুনিয়ে তোমাকে বিয়ে করে এখানে থাকতে প্রস্তাব করলো, তাৎক্ষণিক তোমার ইজ্জত ও আকাক্ষার প্রতি মমত্ববোধ আমাকে রাজী হতে বাধ্য করেছে। যদি কখনও আমি এখান থেকে চলে যেতে চাই তুমি আমার সাথে যাবে?”
“আমি আল্লাহর নামে আপনাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করেছি। আমার জীবন-মরণ আপনার হাতে। এরা আর আমাকে বন্দী করে রাখতে পারবে না। আপনাকে প্রথম দেখাতেই আমার মন বলছিল, এই লোক যদি তোমাকে বিয়ে করতে চায় তাহলে তুমি গ্রহণ করতে পার।”
শুনেছি, এক শ্বেতশুভ্র-শশ্রুধারী লোক নাকি তোমাকে স্বপ্নে বলেছিল যে, এমন এক সন্তান তুমি জন্ম দেবে যে পথভোলা মানুষকে আল্লাহর পথের দিশা দেবে।
সে খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। বললো, এটা আমার আকাঙ্ক্ষা ছিল । আকাক্ষাটা এমনভাবে আমার মধ্যে শিকড় গেড়েছিল যে, আমি নিজের কানে শুনতে পেতাম, “তোমার কোলে এমন শিশু জন্ম নেবে যে সত্যের পথে এতো খ্যাতি অর্জন করবে পৃথিবীর মানুষ তাকে চিরকাল স্মরণ রাখবে।”
তুমি জানো না, হত-দরিদ্র ঘরের সন্তানেরা মিথ্যা বিনাশী হয় না, পেট পূজারীই হয়ে থাকে। এটা তোমার অলীক আকাঙ্ক্ষা। এই অসম্ভব কল্পনা ছেড়ে নিজে সত্য পথের উপর থাকো এটাই যথেষ্ট। আমাদের সন্তান আমাদের মতোই যাযাবর হবে, নয়তো কোন আমীরের ঘরে নোংরা কাজের চাকর হবে।
“আমি কি অবাস্তব কল্পনা করছি। আমার এই আকাক্ষা কি অসম্ভব?”
“যে আকাক্ষা অবাস্তব, তা কল্পনা হয়ে মানুষের মনে সুখ দেয়।” বলল আল হাকাম।
“সেদিন আপনি আমার ভুল শুধরে দেয়ার জন্যে এসেছিলেন। আপনি আমাকে আয়াতের তরজমায় বলেছিলেন, ইবরাহীম (আ.) তাঁর পিতাকে বলেছিলেন, আপনি কেন মূর্তিপূজা করেন, যেগুলো কিছু শোনে না, বলতে পারে না, করতে পারে না, আপনি আমার সাথে আসুন, আমি আপনাকে সত্য পথ দেখাব।’ সে কথাগুলো আমার হৃদয়ে গেঁথে গিয়েছিল। এরপর আমি কুরআন পড়তে বসলেই আমার কানে শুধু একথাই বাজে- তুমি এক ইবরাহীমকে জন্ম দেবে। আমি রাতে নূরানী চেহারার এক সৌম্য কান্তিময় ব্যক্তিকে দেখেছি, তিনি আপনার মতোই আমার ভুল শুধরে সেই আয়াতটিই পড়াচ্ছিলেন। তিনি বলছিলেন, সুন্দর ফুটফুটে অথচ নির্বোধ সন্তান হলে তুমি বেশি খুশি হবে না। কদাকার কিন্তু বুদ্ধিমান সন্তান পেলে সুখী হবে? আমি সেই বুযুর্গ ব্যক্তিকে বলেছি, আমি ইবরাহীমের মতো এমন সত্যের বাহক সন্তান চাই যাঁর পিতা বিপথে থাকলেও পিতাকে ত্যাগ করতে দ্বিধা করবে না। আর মেয়ে হলে যাতে এমন কদাকার হয় যে, কোন ডাকাতের দৃষ্টি ওর প্রতি না পড়ে, কেউ ওকে কিনে নিতে না চায়।”