আমি ছাড়া আর কোন মানুষ কি আপনারা পাননি? আর কোন মানুষের কাছে কেন ওকে বিয়ে দেননি? নাকি আমিই আপনাদের কাছে আসা প্রথম পুরুষ ব্যক্তি?
অনেক লোকই এসেছে। ওকে নিয়ে কাড়াকাড়িও হয়েছে বেশ। কিন্তু ওদের সবাই ব্যবসায়ী। মেয়েটাকে কিনে নিতে চাইলো। কে কার চেয়ে বেশি দেবে এ নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে ওকে নিয়ে বিবাদও পর্যাপ্ত হয়ে গেছে। আমরা একবার ব্যবসায়ীদের হাতে ওকে তুলে দেয়ার চিন্তাও করেছিলাম। কিন্তু মেয়েটা বড়ই জেদি। এমন করলে সে আত্মহত্যা করবে বলে হুমকি দিল। এরপর এ সিদ্ধান্ত বাদ দিলাম।
সেই সময় অবাধে নারী কেনা-বেচা হতো। ধনাঢ্য ও আমীর-উমরা, পছন্দ মতো নারীদের টাকার বিনিময়ে সগ্রহ করে নিজেদের হেরেম গুলজার করতো। ইরানী বেদুঈন ও যাযাবর মেয়েদের অঙ্গসৌষ্ঠব, রূপলাবণ্য, সৌন্দর্য কিংবদিতুল্য। এ জন্য এ ধরনের যাযাবর গোত্রে নারীলোভীরা মেয়ের তালাশ করতো। মেয়ে বেচা-কেনা করা বেদুঈন ও যাযাবর গোত্রের মধ্যে কোন দোষণীয় ছিল না। অনেকটাই রেওয়াজে পরিণত হয়ে গিয়েছিলো। রীতিমতো মানুষ কেনা-বেচার হাট বসতো। ওসব হাটে সব ধরনের নারী-পুরুষ বেচা-কেনা হতো। যুবতী নারী ও বালক-বালিকাদের সরবরাহ আসত ডাকাতদের কাছ থেকে। ওরা মুসাফিরদের আক্রমণ করে ধন-সম্পদ ও ছোট ছেলে-মেয়ে ও যুবতী মেয়েদের অপহরণ করে বাজারে এনে বিক্রি করে দিতে। ওসব হাটের সুন্দরী যুবতী-কিশোরীদের কদর ছিল বেশি। অধিকাংশ আমীর ক্ষমতাবান লোকেরা সুন্দরী মেয়েদের চড়া দামে খরিদ করে নিজেদের হেরেমের শোভা বর্ধনা করতো। শরিফ মেহমানদের মনোরঞ্জন, আপ্যায়ন ও নিজেদের সেবা-যত্নের কাজে, আত্মদৈহিক মনোরঞ্জনে ব্যবহার করা হতো এদের। ক্ষমতার মসনদে থাকা লোকদেরকেও স্বার্থান্বেষী মহল সুন্দরী যুবতী উপঢৌকন দিতো।
কোন যাযাবর বেদুঈন মেয়ে বিক্রি করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে এমন তো শুনিনি। আপনারা ওর কথা মেনে নিলেন কেন?
ও এমন সব কথা বলে যে, এতে আমাদের ভয় হয়। বলল এক বুড়ো।
তুমি হয়তো জানো, আমাদের মতো ছন্নছাড়া মানুষের মধ্যে ধর্ম-কর্ম তেমন থাকে না। কোন মানুষ যদি সুন্দরী মেয়েকে চড়া দামে বিক্রি করে দিতে পারে, নিজ স্ত্রীকেও বেশি টাকা পেয়ে তালাক দিতে পারে, তার আর ধর্ম থাকে! কিন্তু আমরা মুসলমান। ধর্ম-কর্ম ঠিকমতো পালন না করলেও খোদার ভয় তো আছে। আমরা কুরআন কিতাব ভয় করি। মরণেরও ভয় আছে। এই মেয়েটা কুরআন পড়ে। ও আমাদের বলেছে, সে নাকি সাদা ও দাড়িওয়ালা এক ব্যক্তিকে স্বপ্নে দেখেছে। তিনি তাকে বলেছেন, “তুমি কখনও কোন ব্যক্তির কেনা দাসী হবে না। তুমি বিয়ে করে কারো স্ত্রী হবে। তোমার পেটে এমন এক সন্তান জন্ম নেবে যে পথ ভোলা বিভ্রান্ত মানুষকে ধর্মের সঠিক পথ দেখাবে, দুঃখী মানুষের সেবা করবে।”
ওকি প্রায়ই এমন স্বপ্ন দেখে আমিও মাঝে মধ্যে এ ধরনের স্বপ্ন দেখি। বলল আল হাকাম।
দুই চাঁদ আগের ঘটনা। আমরা মেয়েটিকে বিক্রি করে দিয়েছিলাম। ক্রেতার হাতে পুরো দাম ছিল না। আমরা মেয়েটির বিনিময়ে স্বর্ণমুদ্রা দাবী করেছিলাম। বিক্রির কথা শুনে মেয়েটি বলছিল, আমি পালিয়ে যাব।
ওর পালানোর কথা শুনে রাতে ওর তাঁবুর বাইরে দুজনকে পাহারা দিতে বললাম। ওর পালানোর পথ আটকে দেয়ার কথা শুনে বলল, “আমার উদর থেকে কোন হারামজাদার জন্ম হবে না। জীবন থাকতে আমি তা হতে দেবো না। আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু করতে চাইলে তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে।”
মধ্যরাতে মেঘের গর্জনে আমাদের ঘুম ভেঙ্গে গেল। প্রচণ্ড ঝড় আর ভারী বর্ষণে আমাদের সব তাঁবু লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল। বিজলি আর আকাশের ভয়ঙ্কর গর্জনে আমরা ভড়কে গেলাম। বিজলির ঝলকানি আর মেঘের গর্জনে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠতে লাগল। হঠাৎ করে বিজলি থেমে গিয়ে ঘন অন্ধকার নেমে এলো। আমরা নিজের হাতটাও ঠাহর করতে পারছিলাম না। ভয়ে আতঙ্কে ছোট ছেলে-মেয়ে, নারী-শিশু চিৎকার জুড়ে দিল। কোলের বাচ্চাগুলোকে বড়রা বুকে চেপে ধরে জীবন বাঁচাতে চেষ্টা করল। কিন্তু আকাশের বিকট গর্জন আর ঝড়ের ভাবে বড়রাও ভয়ে কাঁপছিল। বিজলির এককটা ঝলকানিতে মৃত্যুর সাক্ষাত পাচ্ছিলাম আমরা। অথচ এই মেয়েটি ছিল সম্পূর্ণ নির্বিকার নিরুদ্বিগ্ন। আমরা যখন জীবন বাঁচানোর কোন আশ্রয় পাচ্ছিলাম না, সে তখন একটি তাঁবু ধরে অবিচল বসেছিল। এমন সময় একটি গাছের ডাল এসে আমাদের সামনে ভেঙে পড়ল। মৃত্যু আশঙ্কায় সবাই এক সাথে চিৎকার করে উঠল। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে মরণ থেকে লুকাতে চাচ্ছিল। কিন্তু এই মেয়েটি নির্ভয়ে চিৎকার করে বলছিল, কেউ আযান দাও আর বাকীরা যে যেখানে আছে সে জায়গায় লুটিয়ে পড়।’ তিনজন ওর কথামতো আযান দিতে শুরু করল। বাকীরা প্রলয়ঙ্করী ঝড়-বৃষ্টিতে কাদা-পানির মধ্যেই সে জায়গায় লুটিয়ে পড়লো। আর আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা ভিক্ষা…।
অনেকক্ষণ পর তুফান থামল। এর চেয়েও তীব্র তুফানের মুখোমুখি আমরা হয়েছি কিন্তু এমন আতঙ্কিত হইনি কখনো। মাথার উপরে আসমান ও পায়ের নীচে মাটি, এই তো আমাদের ঠিকানা। আসমান তার অফুরন্ত নেয়ামত দিয়ে আমাদের প্রাণ বাঁচাতে সহযোগিতা করে আবার কখনো আমাদের উপর দুর্ভোগও চাপিয়ে দেয়। আসমান-জমিনের আপতিত এসব সুখ-দুঃখ মিলিয়েই আমরা বেঁচে আছি। এসবে কখনও ভীত হই না, কিন্তু ওই রাতের ঝড়-বৃষ্টি ছিল ভয়ঙ্কর, তার চিত্র ছিল ভয়াল। আমরা সেই ঝড়কে এই মেয়ের অভিশাপ মনে করছিলাম।