আল হাকাম তার ভুল শুধরে দিলো। নিজের ভুল ধরতে পেলে কৃতজ্ঞচিত্ত দৃষ্টিতে কিশোরী আল হাকামের মুখের দিকে তাকাল।
এই আয়াতের অর্থ জানো?
কিছু কিছু বুঝি, পরিষ্কার না, লাজনম্র ভাষায় বলল কিশোরী। আমাদের সাথে এক বুযুর্গ ব্যক্তি থাকতেন। তিনি আমাকে কুরআন শরীফ পড়িয়েছেন, অর্থও শিখাতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু সাপের দংশনে তিনি মারা গেছেন। এখন
আমি কিছু কিছু অর্থ বুঝি কিন্তু সব আয়াতের অর্থ বুঝি না।
আমার কাছে শোন! আমি তোমাকে অর্থ বলে দিচ্ছি :
“ইবরাহীমকে স্মরণ কর, নিশ্চয়ই তিনি সত্য নবী ছিলেন। তিনি তাঁর পিতাকে বলেছিলেন, আপনি এমন সব জিনিসের পূজা করেন, যেগুলো কোন কিছু শুনতে পারে না। আমার কাছে এমন তথ্য আছে যা আপনার জানা নেই। আপনি আমার কথা মানুন, আমি আপনাকে সঠিক পথের সন্ধান দিব।”
আল হাকাম কিশোরীকে পঠিত আয়াতের অর্থ বুঝিয়ে দেয়ার পর বলল, সামনের আয়াতে আল্লাহ্ তায়ালা ইরশাদ করেছেন
“অতঃপর ইবরাহীম যখন ওসব মূর্তি ও মূর্তিপূজারীদের থেকে ভিন্ন হয়ে গেলেন, তখন আমি তাকে ইসহাক ও ইয়াকুব দান করেছি এবং সবাইকে নবী বানিয়েছি।”
তুমি জানো, এখানে আল্লাহ্ তায়ালা কোন্ ঘটনা বললেন? ওরা মূর্তি পূজা তো আর ওই সব মাটির মূর্তির কাছে নিজেদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য না করতো। তুমি তো জানো, আল্লাহ্ ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই।
আল হাকাম কিশোরীকে বলছিল, যেসব মূর্তি কিছু বলতে পারে না, শুনতে পারে না, কিছু করতে পারে না পৌত্তলিকরা সে সবের পূজা করে, আসলে সবই এদের হাতে তৈরি মাটির পুতুল।
আল হাকামের মাথা থেকে পা পর্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল কিশোরী, আর তয় হয়ে শুনছিল তার কথা। মুখে কোন শব্দ ছিল না। তার হৃদয় মনে অবিল আনন্দের ঢেউ তরঙ্গায়িত হচ্ছিল। গোত্রের অন্যান্য পুরুষও ইতোমধ্যে আল হাকামের পাশে এসে বসে গেল।
হঠাৎ গমনোদ্যত হলো আল হাকাম। পা বাড়াল চলে যাওয়ার জন্য। বুড়োরা তাকে থামাল। কিশোরীর কাছ থেকে একটু দূরে বড়দের আগের জায়লায় গিয়ে বসল সে।
তুমি কে? কোথা থেকে এসেছো? কোথায় যাবে? জিজ্ঞেস করল এক বুড়ো।
ইরানের মাটি আমাদের জন্য সংকীর্ণ হয়ে গেছে। বলল আল হাকাম। যাদের বাপ-দাদা ন্যায়-ইনসাফের দ্বারা ইরানের মানুষকে দিয়েছিল সীমাহীন মর্যাদা, যারা মানুষের জন্য ইরানকে পরিণত করেছিল সুখের ঠিকানা, তাদের সন্তানেরা আজ জঙ্গলের জীবজন্তুর মত বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমরা তো কোন কীট-পতঙ্গ ছিলাম না যে, পেটের ক্ষুধা নিবৃত্ত করতে ঝাড়জঙ্গলে বসবাস করবো, কিন্তু তিন চার পুরুষ যাবত আমাদের তাই করতে হচ্ছে। জালেমদের অত্যাচার ও জুলুমে অতিষ্ঠ হয়ে আমাদের খান্দান যাযাবরে পরিণত হয়েছে। যেদিকে যখন মন চায় সে দিকে চলতে থাকে।
তুমি কি বলতে চাচ্ছো, তুমি ন্যায় শাসক নওশেরোয়ার বংশধর? বলল এক বুড়ো।
আমাদের বাপ-দাদার মুখে তার অনেক কিচ্ছা-কাহিনী শুনেছি, কিন্তু আমাদের কাছে ওই সব কাহিনী রূপকথার গল্পের মতো মনে হয়।
আচ্ছা, তোমরা কোথায় তাঁবু ফেলেছো? জিজ্ঞাসু নেত্রে প্রশ্ন করল অপর বুড়ো।
আমি একা। বলল আল হাকাম।
ছোটবেলা থেকেই কুরআন শরীফের সাথে আমি জীবনের অধিকাংশ সময় মসজিদেই কাটিয়েছি।
তোমার কথা দারুণ সুন্দর। বলল এক বুড়ো। যদি থাকতে চাও আমাদের সাথে থাকতে পারো, আর যেতে চাইলেও অন্তত একদিন আমাদের এখানে আতিথ্য গ্রহণ করো।
আজ রাতটা এখানেই থেকে যাওয়ার চিন্তা করল আল হাকাম। খুব একটা জ্ঞান-গরীমাওয়ালা লোক নয় আল হাকাম, কিন্তু যাযাবরদের কাছে আল হাকামর্কে মনে হলো বুযুর্গ লোক। থেকে যাওয়ার প্রস্তাবে রাজী হওয়ার পর তার পাশে দাঁড়ালো সবাই।
আল হাকামের কথা সবাইকে রূপকথার গল্পের মতো স্বপ্নলোকে নিয়ে যাচ্ছিল। সেই বিকেল থেকে রাত অবধি একনাগাড়ে তার কথাই শুনছিল তাবুর সব লোক।
রাত যখন সন্ধ্যা পেরিয়ে গম্ভীর হতে থাকল, একজন দু’জন করে উঠতে শুরু করলো। শেষ পর্যন্ত যুবক, পৌঢ়, শিশু-কিশোর, মহিলা সবাই তাঁবুতে চলে গেল। বুড়ো দু’জন খোলা আকাশের নীচে বিছানা পেতে আল হাকামের কাছেই শুয়ে পড়ল। নানা কথার ফাঁকে দু’বুড়ো জোর দিয়ে বলল :
তুমি আমাদের সাথে থাক।
আল হাকাম ভাবছিল, ওরা কেন তাকে তাদের সাথে থাকতে বলছে। আল হকামের মনের কোণে কিশোরীর শান্ত সৌম্য কান্তিময় চেহারা উঁকি মারল। কিন্তু বেশি ভাবনায় না গিয়ে সরাসরি বুড়োদের জিজ্ঞেস করে বসল আল হাকাম:
“আমার দ্বারা কি আপনাদের কোন কাজ হবে?”
আমাদের গোত্রে পুরুষ কম, মহিলা বেশি। পুরুষ বেশি থাকতে সুবিধা। আমাদের নানাবিধ ভয়। জঙ্গলের হিংস্র জীব-জন্তুই নয় এর চেয়েও হিংস্র অনুষ-লুটেরা, ডাকুদের ভয়টা বেশি। ওই যে মেয়েটা, ওকে নিয়ে আমাদের ভীষণ দুশ্চিন্তা। আমাদের দলে কোন অবিবাহিত পুরুষ নেই। বড়দের সবার বউ আছে, আর বাকীরা ছোট। এই মেয়েটার জন্য কোন বর পাওয়া যাচ্ছে না। ওটা আমাদের ঘাড়ে কঠিন দায়িত্বের বোঝা হয়ে আছে। বলল এক বুড়ো।
‘ওকে তো তুমি দেখেছো, ওর কুরআন পড়া শুনেই তো তুমি এদিকে এলে। ও কুপও হয়তো দেখে থাকবে তুমি। তুমি আমাদের সাথে থাক, আর ওই মেটোকে বিয়ে কর।’ বলল অপর বুড়ো।