রোগ ও অসুস্থতা সুলতান মাহমূদকে শয্যাশায়ী করতে পারলো না। কারণ তার উজির ও সেনাপতিগণ শুধু তার আজ্ঞাবহ ছিলেন না, ছিলেন তার বন্ধুও। তারা যেমন ছিলেন তার সহকর্মী তেমনই ছিলেন তার বহু গোপন রহস্য ও ভেদের বাহক। একদল নিবেদিত প্রাণ সহকর্মী যোদ্ধা এবং জীবনত্যাগী সঙ্গীর বদৌলতেই তিনি নতুন নতুন ইতিহাস রচনা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তার সহযোদ্ধারা বিন্দুমাত্র তার প্রতি অশ্রদ্ধা দেখাননি। আনুগত্যে নির্দেশ পালনে সামান্য ত্রুটি করেন নি। জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও সুলতান সহকর্মী ও উপদেষ্টাদের পরামর্শে বদল করেছেন। তাদের অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধিকে সম্মান করেছেন।
কিন্তু তারাই যখন সুলতানকে অসুস্থতাজনিত কারণে বিশ্রাম ও চিকিৎসার প্রতি মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দিলেন, তখন হেসে সকলের পরামর্শই তিনি উড়িয়ে দিলেন। তিনি তার ছেলেদের ডেকে বললেন, আমার মধ্যে যে শক্তি আছে তা আল্লাহ তোমাদের মধ্যেও দিয়েছেন। সেই সুপ্ত শক্তিকে জাগিয়ে তোল, ইচ্ছাশক্তি ও লক্ষ উদ্দেশ্যকে পবিত্র রাখো। শুধু আল্লাহর সাহায্য কামনা করো এবং কুরআনকেই জীবনের পাথেয় এবং দিক নির্দেশক বানাও। তাহলে আত্মশক্তিতে তোমরা বলীয়ান হতে পারবে।
সুলতান মাহমুদের পরিবার এবং তার সহকর্মী ও কর্মকর্তাগণ যখন তার অসুস্থতা নিয়ে চরম উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় নিপতিত ঠিক সেই সময় সুলতান মাহমূদ শারীরিক এই দুরবস্থা উপেক্ষা করে নতুন এক রণক্ষেত্রে রওয়ানা হলেন। সেই রণক্ষেত্র ছিলো অবশিষ্ট সেলজুকী জনগোষ্ঠী। এরা সংগঠিত হয়ে আবারো গযনী সালতানাতের প্রতি হুমকি হয়ে উঠেছিলো এবং গযনী সালতানাতের প্রতি নানা ধরনের হুঁশিয়ারীও উচ্চারণ করেছিলো। সেলজুকীদের শেষবারের মতো পদানত করে সুলতান মাহমূদ ইস্পাহান ও রায় এলাকাকে গযনী সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত করলেন এবং তার ছেলে মাসউদকে বিজিত এলাকার শাসক নিযুক্ত করলেন।
অবশেষে তিনি হাওয়া বদল করতে বলখ চলে গেলেন। কিন্তু সেখানেও তাঁর পক্ষে পূর্ণ বিশ্রাম নেয়া সম্ভব হলো না। রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যস্ত থাকলেন এবং বিভিন্ন প্রদেশ সফর করলেন। এভাবে ১০২৯ সালের শীত ও গ্রীষ্মকাল তিনি বলখেই কাটালেন। এক পর্যায়ে এখানকার আবহাওয়াও তার প্রতিকুল হয়ে উঠলো। আসলে তখন দুনিয়ার আবহাওয়াই তার জন্যে অসহ্য হয়ে উঠেছিলো।
একদিন তিনি বলখ ছেড়ে গযনী চলে যাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন। কর্মকর্তারা তাকে বিশেষ বাহনে গযনী নিয়ে এলেন। কিন্তু গযনী পৌঁছেই তিনি জ্ঞান হারালেন। সুলতানের একান্ত চিকিৎসক তাকে পরীক্ষা করলেন। চিকিৎসকের দু’চোখ গড়িয়ে অঝোরধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো। তিনি তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন, আমাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন সুলতান। সুলতান কিছু একটা বলার জন্যে তার হাত উপরে উঠালেন কিন্তু হাত উঁচিয়ে রাখতে পারলেন না। হাত অসাড় হয়ে তার বুকে আঁচড়ে পড়লো। অন্তিম অবস্থা দেখে তাঁর স্ত্রী ডাকলেন, ছেলেরা আব্বা আব্বা করে বহু ডাকলো কিন্তু সুলতানের পক্ষে সাড়া দেয়া সম্ভব হলো না। তখন শুধু তার শ্বাসটুকুই অব্যাহত ছিলো কথা বলার শক্তি নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিলো।
এমতাবস্থায় শহরের সবচেয়ে সুকণ্ঠের অধিকারী হাফেযদেরকে তার শিয়রের কাছে কুরআন তেলাওয়াতের জন্যে বসিয়ে দেয়া হলো। কুরআনে কারীম তিলাওয়াতের সময় মাঝে মধ্যেই সুলতানের শরীর দুলে উঠছিলো এবং তার ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটে উঠছিলো। তাতে বুঝা যাচ্ছিলো, কুরআনের ভাষা তিনি শুনছিলেন এবং অনুধাবন করতে পারছিলেন । তেলাওয়াত শুরুর আগে তার শরীর কিছুটা নীলাভ ও বিবর্ণরূপ ধারণ করেছিল কিন্তু তেলাওয়াতের সাথে সাথে তা কমে আসে এবং একটা মায়াবী ও আলোকিত ভাব তার সারা দেহে ফুটে উঠে।
যে ক্ষণজন্মা অমিততেজী জগৎশ্রেষ্ঠ বীর অসংখ্য বীর পাহলোয়ানকে তার সামনে হাঁটু গেড়ে বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য করেছিলেন, অক্ষয় অজেয় পাথুরে খোদাদের যিনি টুকরো টুকরো করে ঘোড়ার পায়ে পিষ্ট করেছিলেন, সেই দিগ্বিজয়ী বীর পুরুষ এখন স্থবির নিশ্চল। তাঁর দেহে একটু নড়াচড়া করার সামর্থও নেই।
১০৩০ সালের ৩০ এপ্রিল মোতাবেক ৪২১ হিজরী সনের ২৩ রবিউচ্ছানী বৃহস্পতিবার বিকাল পাঁচটায় শেষবারের মতো ইতিহাসের এই বীরপুরুষের ঠোঁটে ঈষৎ হাসির রেখা ফুটে উঠে এবং তখনই তিনি শেষবারের মতো নিঃশ্বাস ত্যাগ করে দুনিয়া থেকে চিরদিনের জন্যে বিদায় নেন।
মৃত্যু নিশ্চিত হয়ে চিকিৎসক ডুকরে কেঁদে উঠেন। মুসলিম ইতিহাসে মূর্তি সংহারী নামে খ্যাত সুলতান মাহমূদকে সেই রাতের ইশার নামাযের পর মশালের আলোয় তার প্রিয় বাগান ফিরোজীবাগে দাফন করা হয়। এই বাগানে প্রায়ই তিনি বিশ্রাম করতেন, পায়চারী করতেন।
দাফনের পর সুলতান মাহমূদের ছেলেরা তার পিতার কবরকে কেন্দ্র করে বিশাল স্থাপনা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কিন্তু এই কবরস্থানের প্রতি সাধারণ মানুষ ও পরবর্তীকালের মুসলিম বিদ্বেষীরা বহু অন্যায় ও অত্যাচার করেছে। অতি ভক্তরা বরকতের উদ্দেশ্যে তার কবরের মাটি ও স্থাপনার চৌকাঠ কেটে নিতে শুরু করে। ফলে বাধ্য হয়ে তার কবরটির চিহ্ন মুছে দিয়ে সেখানে আরো বহু কবর তৈরী করা হয়।