এক পর্যায়ে যখন নৌকা নিয়ে পালাতে শুরু করলো জাঠরা তখন গযনী বাহিনী তাদের পিছু ধাওয়া করতে লাগলো। এবং যখনই তারা কোন চর বা দ্বীপে উঠতে চেষ্টা করেছে গযনীর সেনারা সেই চরে অগ্নিবোমা নিক্ষেপ করে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। এভাবে চর ও দ্বীপের যেসব ঝুপড়িতে জাঠদের স্ত্রী সন্তানরা অবস্থান করছিলো সেগুলোও বোমার আগুনে পুড়তে লাগলো। আর নারী শিশুরা আর্তচিৎকার করে বাঁচার জন্যে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়লো কিন্তু তাদের আশ্রয় কিংবা বাঁচানোর মতো কোন সক্ষম জাঠ অবশিষ্ট ছিলো না । যেসব জাঠ প্রাণ ভয়ে ঝোঁপ ঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে ছিলো এদেরকেও ধরে ধরে গযনীর সেনারা নদীতে নয়তো নৌকায় নিক্ষেপ করছিলো। যেসব নারী শিশু বেঁচে ছিলো এরা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেলো। বস্তুত সংঘবদ্ধ জাঠ জনগোষ্ঠী বলে আর অবশিষ্ট কিছুই রইলো না। জাঠরা অতি আত্মবিশ্বাসে কচুকাটা হয়ে গেলো।
১০২৭ সালের জুলাই মাসে সুলতান মাহমূদ জাঠদের নিমূর্ল করে গযনী ফিরলেন। এবার চিকিৎসক তাকে দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। কারণ তখন অসুস্থতা ও দুর্বলতার ছাপ সুলতানের চেহারায় ফুটে উঠেছিলো। ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, এবার সুলতান যখন দ্বীপাঞ্চলে জাঠদের সাথে যুদ্ধ করতে গেলেন তখন চর দ্বীপের ম্যালেরিয়াবাহী মশা তার শরীরে ম্যালেরিয়ার জীবাণুর সংক্রমণ ঘটায়। কিন্তু যুদ্ধে থাকার কারণে তিনি তার অসুস্থতার কথা সফরসঙ্গী চিকিৎসকদের বলেননি।
তিনি গযনী ফিরে এলে দীর্ঘদিনের ম্যালেরিয়া জ্বরের প্রকোপে তার বুকে ব্যথা শুরু হয়ে গেলো। এক পর্যায়ে দেখা গেলো তার পাকস্থলীর কার্যকারিতাও রহিত হওয়ার উপক্রম হয়ে গেছে।
সুলতানের বয়স তখন ৫৭ বছর। এর মধ্যে ৪০ বছর তার কেটেছে যুদ্ধ ময়দান কিংবা রণ প্রস্তুতি কিংবা যুদ্ধ সফরে। এর মধ্যে যতটুকু সময় তিনি গযনী থেকেছেন তখন ব্যস্ত থেকেছেন শাসনযন্ত্র, সেনাবাহিনীর ঘাটতি ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিয়ে। তাছাড়া চতুর্মুখী প্রতিপক্ষের মোকাবেলা করে অভিষ্ট লক্ষে উপনীত হওয়ার পাহাড়সম দুশ্চিন্তা তাকে সারাক্ষণ পেরেশান করে রাখতো। সুলতানের আশংকাজনক শারীরিক অবনতি দেখে তার একান্ত চিকিৎসক একদিন উজির ও প্রধান সেনাপতি আবু আব্দুল্লাহ আলতাঈ, সেনাপতি আরসালান জাযেব ও সেনাপতি আবুল হাসানকে একত্রিত করে বললেন
সুলতান তার মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হওয়ায় বিষয়টি কাউকে না জানানোর জন্যে আমার কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করেছিলেন, কিন্তু এখন তার শারীরিক অবস্থা এতোটাই অবনতি ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে যে, না জানানোটাকে আমি খেয়ানত মনে করছি। কারণ সুলতান মাহমূদ এর সুস্থতা শুধু তার পরিবার পরিজন স্ত্রী সন্তানের ব্যাপার নয়।
সুলতান মাহমূদ মুসলিম উম্মাহর জন্য অমূল্য সম্পদ। আপনারা জানেন, মুহাম্মদ বিন কাসিমের বহু বছর পর গয়নী একজন সুলতান মাহমূদ জন্ম দিয়েছে। কিন্তু ততো দিনে হিন্দুস্তান আবারো মূর্তি পূজার অন্ধকারে তলিয়ে গিয়েছিলো এবং বিন কাসিমের জ্বালানো ইসলামের আলো বিলীন হয়ে পড়েছিলো। এখন সেই ক্ষণজন্মা সুলতান মাহমূদও যাওয়ার পথে। না জানি তিনি চলে গেলে আবার ইসলামের আলো নিষ্প্রভ হতে শুরু করে কি-না। কে জানে! আবার কখন আরেকজন বিন কাসিম আসবে আবার কখন আরেকজন সুলতান মাহমুদ আসবে। কে জানে আবার ইসলাম ও মুসলমানরা কাফেবদের রক্ত চক্ষুর শিকার হয়ে পড়ে কি-না?
কি হয়েছে সুলতানের? জানতে চাইলেন উজির।
সুলতানের যক্ষ্মা হয়েছে। সেই সাথে তার হৃদযন্ত্র ও পাকস্থলিও বিগড়ে গেছে। এটা আজ নয়, আমি তিন বছর আগেই এই রোগ সনাক্ত করেছি, তাকে সতর্ক ও সচেতন হওয়ার অনুরোধ করেছি। বিশ্রাম ও ঠিকমতো ওষুধ সেবনের পরামর্শ দিয়েছি কিন্তু তিনি কাজের চাপে দায়িত্বের ব্যস্ততায় নিজের শরীরের প্রতি সুবিচার করতে পারেন নি। শরীরের যতটুকু বিশ্রাম ও যত্ন নেয়ার দরকার ছিলো তারপক্ষে মোটেও তা করা সম্ভব হয়নি। বরঞ্চ বলা চলে নিজের ভেতরে তিনি রোগ লালন করেছেন।
চিকিৎসক শাইখুল আসফান্দ বলেন, আমাদের সুলতান বড় বড় শক্তিধরকে পরাজিত করেছেন অবশেষে মৃত্যুকেও কাবু করে ফেলেছিলেন। কারণ যতো দিন থেকে তিনি এই অসুখে আক্রান্ত সুলতান ছাড়া যে কোন মানুষ হলে এতো দিনে নির্ঘাত মৃত্যু বরণ করতো কিন্তু সুলতানের দেহকোষকে এই মরণব্যাধি ভেঙে দেয়ার পরও তিনি আত্মশক্তিতে বলিয়ান হয়ে একের পর এক যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন, যদিও রোগ তার দেহের প্রতিরোধ শক্তি সম্পূর্ণ নিঃশেষ করে দিচ্ছিলো। সুলতান প্রমাণ করেছেন স্থির লক্ষবস্তু, অবিচল আত্মবিশ্বাস, দৃঢ় সংকল্প এবং উদ্দেশ্য মহান ও পবিত্র হলে শরীর অক্ষম হলেও আত্মশক্তি দিয়ে অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়।
বস্তুত সুলতানকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে অচলই বলা যায়। আপনাদের প্রতি আমার অনুরোধ! যে কোন মূল্যে আপনারা সুলতানকে সবকিছু থেকে মনোযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেহের প্রতি মনোযোগী ও চিকিৎসার প্রতি যত্নবান হওয়ার জন্যে রাজি করান। এটা শুধু সুলতানের পরিবারের প্রতি নয়, গোটা মুসলিম দুনিয়ার প্রতি খুবই কল্যাণকর হবে। সুলতানের সুস্থতা হিন্দুস্ত নের মুসলমানদের জন্যেও রহমত বয়ে আনবে। যারা শতশত বছর পর নিজের অতীত ঐতিহ্য ফিরে পেয়েছে এবং হিন্দুদের নিষ্পেষণ থেকে মুক্ত হয়ে মাথা উঁচু করে স্বাধীনভাবে ধর্মকর্ম করতে পারছে। সুলতানের শারীরিক অবস্থা এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, তার বিছানা থেকেই উঠা উচিত নয়।