গযনী সৈন্যরা ‘আল্লাহু আকবার’ বলে বীর বি’ক্রমে হামলে পড়লো জাঠদের উপর। জাঠরাও তাদের ভাষায় চিৎকার দিচ্ছিল কিন্তু তাদের ভাষার চিৎকারের মধ্যে বাস্তবে উদ্দীপনামূলক কিছু ছিলো না। তবে তারা ছিলো লড়াকু ও নির্ভিক । দেখতে দেখতে অল্পক্ষণের মধ্যে উভয় বাহিনীর নৌযানের মধ্যে শুরু হলো সংঘর্ষ। গযনীর সৈন্যরা হঠাৎ করে তীরের পাশাপাশি জাঠদের নৌকার দিকে ছুঁড়তে শুরু করলো অগ্নিবাহি জ্বালানী ভর্তি ঘটি সদৃশ বোমা। এসব ঘটি নিক্ষিপ্ত হওয়ার সাথে সাথে প্রতিটি নৌযানে আগুন ছড়িয়ে পড়ছিলো এবং মানুষ আসবাব নৌকাসহ সবকিছুকেই গ্রাস করছিলো আগুন প্রাণ বাঁচাতে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ছিলো জাঠযোদ্ধারা কিন্তু অনাকাক্ষিত এই অগ্নি বোমার আঘাতেও জাঠরা হতোদ্যম হলো না। তারা পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে মুসলমানদের নৌকায় আরোহণ করার চেষ্টা করছিল কিন্তু আরোহণ করতে গিয়ে তারা গযনী বাহিনীর নৌযানের বহিরাবরণে সেঁটে রাখা ধারালো ইস্পাতের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছিল আর উপর থেকে গযনীর তীরন্দাজ ও বর্শাধারীরা তাদের বর্শা ও বল্লম বিদ্ধ করে পানিতে ডুবিয়ে দিচ্ছিলো।
জাঠদের রক্তে লাল হয়ে যাচ্ছিল নদীর পানি কিন্তু তবুও তারা দমার পাত্র ছিলো না। জাঠদের চার হাজার নৌকার বিশাল বহরে গমনী বাহিনীর চৌদ্দশ নৌকা হারিয়ে গিয়েছিলো, দৃশতঃ গঠন শৈলী ভিন্নতর না হলে জাঠদের নৌকার ভীড়ের মধ্যে গযনী বাহিনীকে খুঁজে বের করাই মুশকিল হতো।
নৌকার সাথে নৌকার সংঘর্ষ ঘটিয়ে নৌকা উল্টে দেয়ার বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিলো গযনী সেনাদের। তারা এই কৌশল ব্যবহার করে কয়েকটি জাঠতরী উল্টে দিয়েছিলো কিন্তু জাঠদের তাতে কিছুই হলো না। দেখে মনে হচ্ছিলো এরা যেন পানির কীট। এরা উল্টে যাওয়া নৌকার নীচ থেকে ডুব দিয়ে দূরে ভেসে উঠে প্রতিপক্ষের নৌযানে আরোহণের চেষ্টা করছিলো। জাঠরা প্রবল প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়ে একটা নতুন চাল দিলো। তারা দৃশ্যত পলায়নপর এমন ভাব বোঝানোর জন্য বহু নৌকা তীরে ভিড়িয়ে ডাঙায় নেমে গেলো। এবং কিছুটা ঘুরে নদীরকূল থেকে মুসলমানদের উপর তীর আক্রমণের কৌশল নিলো। কিন্তু জাঠদের এই কৌশলে কোন ফলোদয় হলো না। তাদের সম্ভাব্য এমন পরিস্থিতি মোকাবেলার ব্যবস্থা সুলতান আগেই করে রেখেছিলেন। তিনি রাতের অন্ধকারে দুই ইউনিট তীরন্দাজকে ডাঙায় নামিয়ে দিয়ে নির্দেশ দিয়েছিলেন তীর থেকে দূরে ঘনজঙ্গল ও ঝোঁপ ঝাড়ের আড়ালে নিজেদের লুকিয়ে রাখতে। জাঠরা ওদিকে গেলে অজ্ঞাতস্থান থেকে তীর মেরে ইহলিলা সাঙ্গ করে দিতে। জাঠরা মোটেও জানতো না নৌযানের বাইরেও গযনীর সেনারা ডাঙায় লুকিয়ে থাকতে পারে। যেই না তারা ডাঙায় উঠে পথঘুরে মুসলমানদের উপর আক্রমণের চেষ্টা করলো অমনিতেই তারা গযনীর তীরন্দাজদের অজ্ঞাত তীর বিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে থাকলো। ফলে ফলাফল দাঁড়ালো, যেসব জাঠ ডাঙায় গিয়েছিলো এদের পক্ষে আর আক্রমণে ফিরে আসা সম্ভব হলো না। এদিকে নদীতে জাঠদের সবচেয়ে বেশী সমস্যা তৈরী করেছিলো গযনী বাহিনীর অগ্নিবোমা। অগ্নিবোমায় যেসব নৌযানে আগুন জ্বলে উঠেছিলো গযনীর মাল্লারা সেইসব জ্বলন্ত নৌকার দিকে অন্য জাঠ নৌকাগুলোকে ধাক্কা দিয়ে লাগিয়ে দিচ্ছিলো ফলে একটির আগুন ছড়িয়ে পড়ছিলো আরেকটিতে।
কোন মানুষই পুড়ে মরতে চায় না। জাঠরা অগ্নিদগ্ধ হওয়া থেকে বাঁচার জন্য নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়তো আর মুসলমানদের নৌকায় আরোহণের চেষ্টা করতে গিয়ে তাদের তীরবর্শা বিদ্ধ হয়ে নদীতে হাবুডুবু খেয়ে তলিয়ে যেতো। আর ডাঙায় গযনীর তীরন্দাজদের অজ্ঞাত তীরে বেঘুরে প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছিলো আবেগতাড়িত লড়াকু জাঠরা। তাদের শক্তি সামর্থ সাহস সবকিছুই ছিলো কিন্তু সুলতান মাহমূদের কৌশলের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছিলো জাঠদের দুঃসাহস বীরত্ব। সময় যতই গড়াতে লাগলো সিন্ধুনদীর পানি জাঠদের রক্তে লাল হতে শুরু করলো। আহত জাঠরা পানিতে তরফাতে তরফাতে হাবুডুবু খেয়ে তলিয়ে যেতে লাগলো। সুলতান মাহমূদ তার মাল্লাদের নির্দেশ দিলেন, তোমরা তরীগুলোকে তীরের কাছাকাছি রাখবে। এই নির্দেশের ফলে গযনীর মাল্লারা যখন তাদের তরীগুলোকে তীরের দিকে চাপাতে শুরু করলো যুদ্ধরত জাঠরা চাপে পড়ে গমনী বাহিনীর ঘেরাও-এর মধ্যে পড়ে এক জায়গায় আটকে গেলো। তারা না পারছিলো ডাঙায় উঠতে না পারছিলো গযনী সেনাদের উপর চড়াও হতে।
এর কিছুক্ষণ পরেই জাঠদের অবস্থা এমন হলো যে, তারা প্রতিরোধ যুদ্ধ চালানোর সামর্থও হারিয়ে ফেললো। যারা তখনো যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলো তারা বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়লো। কারণ তাদেরকে সুবিন্যস্তভাবে যুদ্ধ করানোর মতো নেতৃস্থানীয় কেউ অবশিষ্ট ছিলো না। ফলে বেশীক্ষণ আর জাঠদের পক্ষে দৃঢ়ভাবে গযনী বাহিনীর মোকাবেলা করা সম্ভব হলো না। তারা বিক্ষিপ্ত হতে লাগলো। পরাজয় অবশ্যম্ভাবী ভেবে অনেকেই নৌকা থেকে লাফিয়ে পড়ে সাঁতরে তীরে উঠে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করছিলো, কিন্তু তীরে তাদের জন্যে অপেক্ষা করছিলো মৃত্যু। কারণ আগে থেকেই গযনীর সেনারা তীরের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের কজায় নিয়ে নিয়েছিলো। যারাই তীরে উঠে ছিলো তাদের পক্ষে আর বেঁচে থাকা সম্ভব হলো না।