যেদিন সুলতান সুলতান পৌঁছলেন, সে দিনই জাঠদের অবস্থা জানার জন্যে গুপ্তচর পাঠিয়ে দেয়া হলো। অবশ্য সুলতানের নৌ-মহড়া এবং মুলতান আগমনের খবর জাঠদের কাছে গোপন রইলো না। কারণ তখন মুলতানেও ছিলো বিপুল হিন্দুর বসতি। এরা যথারীতি তাদের জ্ঞাতি জাঠদের কাছে সুলতানের নৌ প্রস্তুতির খবর পৌঁছে দিলো। অবশ্য জাঠরা এর বহু আগেই সুলতানের জাঠবিরোধী অভিযান প্রস্তুতির খবর পেয়ে গিয়েছিলো। তা ধৃত ও মুক্তিপ্রাপ্ত সুলতানের মুসলিম গোয়েন্দার জবানী থেকেই জানা গিয়েছিলো। পরবর্তীতে আরো জানা গেছে, জাঠরা তাদের বিরুদ্ধে গযনী সুলতানের অভিযানের খবর পেয়ে অন্তত চার হাজার বিশেষ ধরনের নৌকা তৈরী করেছিলো। জাঠদের ধারণা ছিলো জাঠবিরোধী অভিযানে নদীপথের বিভিন্ন বাধা থাকার কারণে গযনী বাহিনী তাদের বিরুদ্ধে স্থলযুদ্ধ করতে বাহন হিসেবে নৌকা ব্যবহার করবে। ফলে গযনী বাহিনীকে তারা ডাঙায় উঠার আগে নদীতেই প্রতিরোধ করবে এবং নদীতেই সবার সলিল সমাধি ঘটাবে।
গোয়েন্দারা জানিয়ে ছিলো, জাঠ জনগোষ্ঠী তাদের স্ত্রী সন্তানসহ নদীর চরাঞ্চলের দ্বীপগুলোয় গিয়ে আস্তানা গেড়ে ছিলো এবং যুদ্ধের জন্যে তৈরী হচ্ছিলো। তখন নদীর চরাঞ্চল ছাড়া মূল ভূখণ্ডে জাঠ জনগোষ্ঠীর কোন লোকজন ছিলো না।
এ খবর পেয়ে সুলতান মাহমূদ তার সেনাপতিদের নির্দেশ দেন, পরিণতি যাই হোক, আমাদেরকে নদীতে ওদের মোকাবেলা করতে হবে অধিকাংশ ইন্ডিয়ান ও ইংরেজ ঐতিহাসিকের কাছে সুলতান মাহমূদের জাঠ বিরোধী নৌ যুদ্ধ তেমন গুরুত্ব পায়নি। কিন্তু যারা সেই সময়কার ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন এবং সার্বিক ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করেছেন, তাদের বর্ণনা থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়, জাঠদের বিরুদ্ধে পরিচালিত গযনী বাহিনীর নৌ যুদ্ধ ছিলো গযনী বাহিনীর সামরিক উৎকর্ষ ও নৈপুণ্যের অন্যতম নিদর্শন। অবশ্য অধিকাংশ ঐতিহাসিকের বর্ণনায় ঠিক কোন জায়গায় এই যুদ্ধ হয়েছিলো তা সবিশদ বলা হয়নি। কিন্তু মানচিত্র গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়, চন্নাব নদীর তীরে মুলতান শহর অবস্থিত। এর ভাটিতে এক জায়গায় ঝিলম নদী ও রাবী নদী গিয়ে চন্নাব নদীর সাথে মিলিত হয়ে বিশাল মোহনার সৃষ্টি করেছে। এরপর আরো কয়েকটি নদী এই নদীর সাথে মিলিত হয়ে সবগুলোর সম্মিলিত স্রোতধারা গিয়ে সিন্ধু নদীতে পড়েছে।
আজ থেকে প্রায় হাজার বছর আগে ছোট বড় কোন নদীতেই কোন বাধ ড্যাম সেতু তথা কোন প্রতিবন্ধকতা ছিলো না। ফলে স্রোতের পানি বন্ধনহীন ভাবে সব কিছু ভাসিয়ে নিতো। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই বলা যায়, তখনকার সিন্ধুনদীর আকার ছিলো আরো বিশাল। এবং নদীর মাঝে প্রায় জায়গাই চর জেগে উঠেছিলো, যেগুলো ধারণ করেছিলো ছোট দ্বীপের আকার।
ঠিক কোন তারিখে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল ইতিহাস এ সম্পর্কে নীরব। জানা যায়, প্রায় চৌদ্দশ নৌযান নিয়ে মুলতান থেকে সুলতান মাহমূদের কাফেলা জাঠদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করে। ঐতিহাসিক আবুল কাসিম ফারিশতা লিখেছেন, গযনী বাহিনীর নৌযানগুলো ছিলো খুব শক্ত। তদুপরি এগুলোর চারপাশে বর্শার মতো ধারালো লোহার পাত সেঁটে দেয়া হয়েছিলো । যাতে সাধারণ কাঠের নৌকা আঘাত করলে এগুলোর কোন ক্ষতি না হয় এবং কাঠের নৌকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পানি থেকে নৌকায় কেউ যাতে আরোহণ করতে না পারে এজন্যও গযনীর নৌযানগুলোতে প্রতিরোধ ব্যবস্থা রাখা হয়েছিলো। তাছাড়া প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে এই নৌ যুদ্ধেই প্রথম সুলতান মাহমূদ আগুনের ঢিল ব্যবহার করেছেন।
মূলত তখনকার দিনে সেগুলো ছিলো জ্বালানী ভর্তি মাটির ঘটি; যাকে বর্তমানের হ্যান্ড গ্রেনেডের সাথে তুলনা করা যায়। মুলতান থেকে জাঠদের অবস্থান ছিলো ভাটিতে। ফলে গযনী বাহিনীর নৌযানগুলো স্রোতের টানে বিনা কষ্টেই ভাটির দিকে ভেসে যাচ্ছিল। প্রতিটি নৌযান ছিলো সমদূরত্বে। মাঝে ছিলো সুলতান মাহমুদের নৌকা। তা ছাড়া দ্রুত খবর পৌঁছানোর জন্য কিছু নৌকা ছিলো সংবাদবাহক। এগুলো ছিলো দ্রুতগামী এবং তাতে মাল্লাও ছিলো বেশী।
পঞ্চনদের মিলনস্থল পেরিয়ে কিছুটা এগুতেই জাঠদের নৌবহর দেখা গেলো। জাদের নৌকাগুলো ছিলো অর্ধবৃত্তাকারে রাখা। তাদের নৌযানের সংখ্যা এতোটাই বিশাল ছিলো যে, দেখে মনে হচ্ছিল পানি নয় শুধু নৌকা আর নৌকা। যেন বিশাল এলাকা জুড়ে নৌকার মেলা বসেছে। সুলতান মাহমূদ এক সারিতে আসা নৌকাগুলোর গতি থামিয়ে সবগুলোকে পাশাপাশি এক সারিতে স্থাপন করলেন, যাতে জাঠরা তাদেরকে ঘেরাও এর মধ্যে ফেলতে না পারে।
প্রথমে জাঠরা গযনী বাহিনীর দিকে তীর ছুঁড়ে আক্রমণের সূচনা করলো। এরপর সুলতান মাহমূদ আক্রমণের নির্দেশ দিলেন। তিনি প্রতিটি নৌযানের মধ্যে পর্যাপ্ত জায়গা ফাঁকা রাখলেন, যাতে প্রতিটি নৌযান প্রয়োজনে ঘুরতে এবং অগ্রপশ্চাত হতে পারে। এক্ষেত্রে নদীর স্রোত ছিলো গযনী বাহিনীর পক্ষে কারণ তাদেরকে আক্রমণের জন্যে তেমন কষ্ট করতে হচ্ছিল না। কিন্তু জাঠদেরকে আক্রমণ করতে হতো স্রোতের বিপরীতে নৌকা বেয়ে। যাতে প্রচুর জনবল নিয়োগ করতে হতো। ফলে আক্রমণ প্রতি আক্রমণের জন্যে জাঠরা ততোটা সুবিধা পাচ্ছিল না।
এক পর্যায়ে সুলতান মাহমূদ পূর্ণ শক্তিতে জাঠদের প্রতি তীর নিক্ষেপের নির্দেশ দিলেন। জাঠদের তীর ছিলো গযনীর তীরের চেয়ে আরো বেশী সর্বনাসী।