সুযোগ পেয়ে বন্দি গোয়েন্দা বললো, তুমি যদি এখান থেকে আমার পালানোর ব্যবস্থা করতে পারো, তবে আমি তোমাকে সাথে নিয়ে মুলতান চলে যাবো। আর সেখানে গেলে তোমাকে বন্দিনী হয়ে থাকতে হবে না। রাজরানী হয়ে থাকবে।
বন্দির মুখে একথা শুনে মহিলা তাকে জানালো, তোমার আগেও এক মুসলমানকে এরা গ্রেফতার করেছিলো। তার কাছ থেকেই এরা জানতে পারে গযনীর মুসলমানরা জাঠদের উপর আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ খবর পাওয়ার পর থেকেই জাঠরা যুদ্ধ প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। শত শত নৌকা তৈরীর কাজ শুরু হয়। কিন্তু সেই গোয়েন্দা তাদের অনেক তথ্য জানানোর পরও তারা তাকে মুক্তি দেয়নি, হত্যা করে সাগরে ফেলে দেয়।
এক চাঁদনী রাতে নদীতে ভাটা পড়েছে। কোন বাতাস নেই, ঢেউ নেই, শান্ত পরিবেশ। সেই সর্দার পত্নী অতি সন্তর্পণে বন্দি গোয়েন্দার কাছে এসে বললো, যদি পালাতে চাও তাহলে তাড়াতাড়ি আমার সাথে এসো। যুবতী মহিলা গোয়েন্দাকে ঘর থেকে বের করে একটি জঙ্গলাকীর্ণ পথে নদী তীরে নিয়ে এসে একটি ছোট্ট নৌকায় বসিয়ে নৌকার বাঁধন খুলে পানিতে নৌকা ভাসিয়ে দিয়ে বললো, তাড়াতাড়ি বৈঠা হাতে নিয়ে পানিতে চাপ দাও। মহিলা নিজে নৌকার হাল ধরলো এবং দ্রুত নৌকা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো।
তারা নদীর তীর থেকে কিছুটা ভেতরে যেতে না যেতেই নদী তীরে অনেকগুলো মশালের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে গেলো। চাঁদনী রাতের আলোয় জাঠদের বুঝতে অসুবিধা হলো না, সর্দার পত্নীই বন্দীকে নিয়ে পালানোর জন্যে নৌকায় উঠেছে। জাঠরা তাদের লক্ষ করে হুমকি দিলো, যদি বাঁচতে চাও ফিরে এসো। কিন্তু তারা হুমকি শুনে আরো প্রাণপণে নৌকা চালানোর জন্যে চেষ্টা করতে লাগলো। জাঠরা যখন দেখলো, তাদের ফেরার সম্ভাবনা নেই, তখন ওদের লক্ষ করে তীর বৃষ্টি শুরু করলো। হিংস্র ও জংলী জাতি হওয়ার কারণে জাঠরা ছিলো তীরন্দাজীতে পটু। ওদের প্রথম তীরটিই এসে বিদ্ধ হলো সর্দার পত্নীর গায়ে। সে আর্তচিৎকার দিয়ে নৌকায় পড়ে গেলো। অবস্থা বেগতিক দেখে গোয়েন্দা নৌকার তলায় শুয়ে পড়লো এবং জীবনের আশা আল্লাহর উপর ছেড়ে দিলো। গোয়েন্দাকেও পড়ে যেতে দেখে এবং পানির স্রোতে নৌকা ভাসতে দেখে জাঠরা নিশ্চিত হলো ওরা উভয়েই তীরবিদ্ধ হয়ে পড়ে গেছে। ফলে শুধু নৌকা ধরার জন্য তাদের কেউ আর রাতের অন্ধকারে পানিতে ভাসতে চাইলো না।
নদীতে স্রোত ছিলো তীব্র। দেখতে দেখতে নৌকা জাঠদের আয়ত্বের বাইরে চলে গেলো এবং অদৃশ্য হয়ে গেলো! অনেকক্ষণ পর গোয়েন্দা যখন বুঝলো, আর কোন তীর নৌকায় আঘাতের শব্দ হচ্ছে না তখন সে আস্তে করে মাথা তুলে চারপাশটা দেখে নিলো। না, দৃষ্টি সীমার মধ্যে কোন বিপদের আশংকা নেই। তখন সে বৈঠা বেয়ে নৌকাকে বিপরীত তীরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা শুরু করে দিলো।
অনেক ভাটিতে গিয়ে বিপরীত তীরে নৌকা ভেড়াতে সক্ষম হলো গোয়েন্দা। তার শরীরে একাধিক তীরের আঘাত লেগেছে কিন্তু কোনটাই বিদ্ধ হয়নি। রক্তক্ষরণ ও অস্বাভাবিক অবস্থায় নৌকা চালানোয় তার শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়েছিলো। কিন্তু তীরে উঠে থামেনি সে। রাতের অন্ধকারেই সে মুলতানের পথ ধরলো এবং কোথাও বিশ্রাম না নিয়ে একটানা হেঁটে বহু কষ্টে আধামরা অবস্থায় কোনমতে মুলতান পৌঁছলো । মুলতান পৌঁছেই সে গযনীর কর্মকর্তাদের জানালো তার ইতিবৃত্ত। এ খবর গয়নী পৌঁছালে সুলতান মাহমূদ মুলতানের গভর্নরকে নির্দেশ দিলেন, আপনি দ্রুত কুড়িজন করে সৈন্য ধারণ ক্ষমতার একটি নৌবহর তৈরি করুন। খাওয়ারিজম শাহীর বিরুদ্ধে জিউন নদীর নৌ যুদ্ধের অভিজ্ঞতায় বিশেষ ধরনের রণতরী তৈরী করার জন্যে একটি বিশেষ ডিজাইন উদ্ভাবন করে ছিলেন। সুলতান মাহমূদ সেই ডিজাইন মতো রণতরী তৈরীর কারিগর ও কয়েকজন অভিজ্ঞ মাল্লাহ এবং একজন কর্মকর্তাকে নৌকা তৈরির কাজ তদারকীর জন্যে মুলতান পাঠিয়ে দিলেন সুলতান।
১০২৭ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে সুলতানের কাছে খবর এলো, আপনার নির্দেশ অনুযায়ী এক হাজার রণতরী তৈরী হয়ে গেছে। তা ছাড়া জাঠদের রণ প্রস্তুতি এবং তাদের ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্যও রিপোর্ট আকারে সুলতানের কাছে পৌঁছে গেলো। সুলতান মাহমূদ সম্পর্কে অভিযোগ করা হয়, তিনি ধনরত্ন লুটতরাজ করার জন্যে বারবার হিন্দুস্তান আক্রমণ করেছেন। কিন্তু এই অভিযোগের অসাড়তা প্রমাণের জন্য জাঠদের বিরুদ্ধে পরিচালিত তার সর্বশেষ অভিযানই যথেষ্ট। কেননা জাঠদের কোন স্থায়ী বসতি ছিলো না। ছিলো কোন রাজ-রাজত্ব রাজধানী কিংবা দুর্গ ধনাগার।
মূলত জাঠরা ছিলো একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর যাযাবর উপজাতি। যারা সেলজুকীদের মতোই পয়সার বিনিময়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজার পক্ষে প্রতিপক্ষকে ঘায়েলের কাজে ব্যবহৃত হতো। শিবমূর্তির পূজারী এই উপজাতি জনগোষ্ঠীর লোকগুলো সেলজুকীদের মতোই গযনী সালতানাত এবং হিন্দুস্তানের মুসলমানদের অস্তিত্বের জন্যে হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়। এরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যখন ব্যাপক দমন পীড়ন ও নির্মূল অভিযানে লিপ্ত হয় তখন বাধ্য হয়েই হিন্দুস্তানের মুসলমানদের সুরক্ষার জন্যে সুলতান মাহমূদ জাঠ দমন অভিযানের সংকল্প করেন।
৪১৮ হিজরী সন মোতাকে ১০২৭ সালের মার্চ মাসের শেষ ভাগে সুলতান মাহমূদ গযনী থেকে জাঠদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেন। মুলতান পৌঁছে তিনি জানতে পারেন, এক হাজার চারশ ষাটটি রণতরী তার নির্দেশনা মতো তৈরি করা হয়েছে। সুলতান সফরের ক্লান্তি উপেক্ষা করে তখনি রণতরীগুলো পর্যবেক্ষণ করার জন্যে নদী তীরে চলে গেলেন। তিনি নদী তীরে গিয়ে সরাসরি একটি রণতরীতে আরোহণ করে মাল্লাদের তা চালাতে বললেন। মাল্লাদের রণতরী চালানোর কৌশল ও অভিজ্ঞতা দেখে তিনি কুড়িজন করে তীরন্দাজ ও বর্শাধারী সৈন্যকে একেকটি নৌকায় আরোহণ করিয়ে সবগুলো নৌকা নদীতে ভাসিয়ে যুদ্ধের মহুড়া দিতে নির্দেশ দিলেন। সৈন্যরা পরম উৎসাহে মনোমুগ্ধকর নৌ মহড়া দেখালো। মাল্লারা নৌকাগুলোকে তাদের অপার কৌশলে নানা দিকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রতিপক্ষকে আঘাত ও প্রত্যাঘাতের অবস্থা সুলতানকে দেখালো। সুলতান নৌ-মহড়া দেখে মুগ্ধ হলেন এবং মহড়া সমাপ্ত করে সবাইকে এক জায়গায় জড়ো করে আরো অধিকতর সামরিক দিক-নির্দেশনা দিলেন।