সময় দ্রুত গড়িয়ে যেতে লাগলো। ইতোমধ্যে লাহোর ও মুলতান থেকে জাঠদের রিপোর্ট আসতে শুরু করলো। রিপোর্টে বলা হয়েছে, জাঠ জাতিগোষ্ঠী সিন্ধু অববাহিকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ি রয়েছে। এরা জাতি হিসেবে লড়াকু এবং দুঃসাহসী। এদের সংখ্যা বিপুল। এরা সাধারণত ঝটিকা আক্রমণ, রাতের বেলায় চোরাগুপ্তা হামলা এবং নদী ও সাগরে দস্যিবৃত্তি করে। এরা নৌপথে লড়াইয়ে খুবই পটু।
তখনকার দিনে সিন্ধু নদী ছিলো খুবই চওড়া। নদীর মাঝে বহু চর ছিলো। যেগুলোর অবস্থা ছিলো অনেকটা দ্বীপের মতো। এসব দ্বীপ সদৃশ চরাঞ্চলগুলোতে ঘনজঙ্গলে বসবাস করতো হাজার হাজার জাঠ। সুলতান মাহমূদের কাছে খবর এলো, দিন দিন জাঠ জনগোষ্ঠী হিন্দুস্তানের মুসলমানদের জন্যে সমস্যারূপে আবির্ভূত হচ্ছে। এরা বংশানুক্রমে সোমনাথের পূজারী হওয়ায় নিরীহ হিন্দুস্তানী মুসলমানদের উপর অত্যাচার করে সোমনাথের প্রতিশোধ নিতে তৎপর।
এসময় হিন্দুস্তানের লাহোর মুলতান ও বর্তমান পাঞ্জাবের গোটা অংশই ছিলো গযনী সালতানাতের দখলে। এবং কাশ্মীর থেকে কনৌজ পর্যন্ত গোটা এলাকা ছিলো গযনী সালতানাতের বিজিত এলাকা। এবং এ অঞ্চলের সকল রাজা মহারাজাই সুলতান মাহমূদের বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছিলেন।
মূলত হিন্দুস্তানের মুসলমানদের নিরাপত্তা বিধানের উদ্দেশ্যেই সুলতান মাহমূদ সম্ভাব্য হুমকি জাঠদের শক্তি খর্ব করতে চাচ্ছিলেন, যাতে ওরা মুসলমানদের জন্যে হুমকি হয়ে না উঠতে পারে এবং পুনর্বার সোমনাথ মন্দির নির্মাণ কিংবা শিবমূর্তির পূজার আয়োজন জোরদার না হয়।
.
১০২৬ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে সুলতানের কাছে খবর পৌঁছলো জাঠ জনগোষ্ঠী গযনীর মোকাবেলায় যুদ্ধ ঘোষণার জন্যে বিশাল রণপ্রস্তুতি শুরু করেছে। জাঠদের যুদ্ধ প্রস্তুতি সম্পর্কে ইতিহাস গ্রন্থে বলা হয়েছে, স্থানীয় এক মুসলমান গযনীর পক্ষে গোয়েন্দাগিরী করতে গিয়ে জাঠদের হাতে গ্রেফতার হয়। পরবর্তীতে সে ফেরার হয়ে ফিরে এসে সুলতানকে জানায়, জাঠদের খবর নেয়ার জন্যে একজন ভবঘুরে হিসেবে ছদ্মবেশে আমি ওদের এলাকার অনেক ভেতরে যাওয়ার জন্যে একদিন একটি ছোট নৌকায় সওয়ার হই। কিন্তু আমি ঝড় তুফান কিংবা বিরূপ পরিস্থিতিতে কিভাবে নৌকা সামলাতে হয় তা জানতাম না। আমি যখন নৌকায় সওয়ার হই তখন নদী ছিলো শান্ত, তেমন ঢেউ ছিলো । স্রোতের টানও আমি বেশী বুঝতে পারিনি। যেই নৌকায় আরোহণ করে নদীতে ভেসেছি স্রোতের টানে নৌকা ভেসে যেতে লাগলো।
আমি যতোই চেষ্টা করছি কূলে নৌকা ভেড়াতে, নৌকা আরো নদীর গভীরে যেতে লাগলো। ঠিক সেই সময় আকাশ অন্ধকার করে এলো প্রবল ঝড় বৃষ্টি। আমি নৌকাকে সামলাতে পারলাম না। নৌকা ঢেউ ও স্রোতের দ্বিমুখী নাচনে হঠাৎ উল্টে গেলো। আমি পানিতে হাবু ডুবু খেয়ে কোন মতে ভাসমান নৌকা আঁকড়ে থাকলাম। স্রোতের টান ও ঢেউ এর ধাক্কায় একসময় একটি দ্বীপ চড়ে গিয়ে আমার নৌকা আঁছড়ে পড়লো। আমি কোন মতে শরীরটাকে টেনে ডাঙ্গায় উঠালাম ঠিকই কিন্তু অচেনা অজানা বিজন জঙ্গল দেখে আমার দেহের অবশিষ্ট শক্তিও নিঃশেষ হয়ে গেলো ।
একসময় আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। যখন জ্ঞান ফিরে আসে তখন দেখি আমি জাঠদের একটি ঝুপড়িতে শুয়ে আছি। আমার কাছে দুজন জাঠ মহিলা বসা ছিলো। হুঁশ ফিরতেই যুবতী মহিলা জানতে চাইলো তুমি কে? কোত্থেকে এসেছো? পানিতে পড়েছো কিভাবে? সে মহিলাদের কাছে নিজের আসল পরিচয় লুকিয়ে কথা বললো। কিন্তু জাঠ পুরুষরা যখন তার সাথে কথা বললো তখন তাদের কাছে এই গোয়েন্দার কথাবার্তা সন্দেহজনক মনে হলো। ফলে তারা বললো, তুই যদি তোর সত্যিকার পরিচয় না বলিস, তাহলে তোকে সাগরে ফেলে দেবো। এই বলে জাঠদের কয়েকজন তাকে ধরে সাগরে ফেলে আসার জন্যে কাঁধে উঠিয়ে নিলো। জীবন ভয়ে সে তখন তার আসল পরিচয় বলে দিলো। কিন্তু জাঠরা এতে সন্তুষ্ট হতে পারলো না। তাকে বন্দি করে রাখলো ২ এবং অধিকতর তথ্য বলার জন্য উৎপীড়ন করতে শুরু করলো। এক পর্যায়ে সে বলে দিলো, আমি গযনীর গোয়েন্দা। গযনী সরকার তোমাদের উপর আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। অচিরেই তারা হামলা করবে।
কিন্তু তাতেও জাঠদের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেলো না সে। তাকে নজরবন্দি করে রাখলো। জাঠরা তার কাছ থেকে জানতে চাইতো গযনী বাহিনীর লড়াই করার কৌশল কি? এরা কিভাবে লড়াই করে। ডাঙ্গায় না পানিতে বেশী পটু ইত্যাদি। বন্দি গোয়েন্দা জাঠদের আস্থা অর্জনের জন্য গযনী বাহিনীর রণকৌশল, তাদের রণ প্রস্তুতি সম্পর্কে আরো বেশী কৰে তথ্য সরবরাহ করতে লাগলো। এক পর্যায়ে তার থাকা খাওয়ার সুবিধা কিছুটা বাড়ালেও তাকে সম্পূর্ণ নজর বন্দি থেকে মুক্তি দিলো না ।
যে যুবতী মহিলা প্রথম দিন তার পাশে বসা ছিলো, সে ছিলো এক জাঠ সর্দারের স্ত্রী। প্রথম দিন থেকেই এই মহিলা বন্দি গোয়েন্দার প্রতি একটু বেশী অনুরাগ দেখাচ্ছিল। জাঠরা যখন বন্দির প্রতি কিছুটা প্রসন্ন হয়ে তাকে স্বাভাবিক খাবার দাবার ও বন্ধনহীন চলাফেরার সুবিধা দিলো, তখন এই যুবতী মহিলা তার সাথে নানা প্রসঙ্গ নিয়ে কথাবার্তা বলতে শুরু করলো। অল্প দিনের মধ্যেই বন্দি গোয়েন্দা ও যুবতীর মধ্যে গড়ে উঠলো হৃদ্যতা। একদিন সুবিধা পেয়ে মহিলা বললো, আমার স্বামী একজন জাঠ সর্দার। এই বুড়ো শয়তানটার সাথে ঘর করার চেয়ে মৃত্যু ভালো। আমার ইচ্ছা করে যদি কোথাও পালিয়ে যেতে পারতাম তাহলে চলে যেতাম।