হিন্দু শাসকরা তাদের জীবন সংকীর্ণ করে ফেলেছিল। তার পরও তারা এখনও নিজেদের আরবী ভাষাভাষী হিসেবে অক্ষুণ্ণ রেখেছে। আমার একান্ত কর্তব্য তাদের জীবনযাত্রাকে নির্বিঘ্ন করা এবং হিন্দুদের দুঃশাসন থেকে তাদের উদ্ধার করা । আমার আরো বহু কাজ করতে হবে শাইখুল আসফান্দ!
আমি যদি আমার দায়িত্বপালন না করি তাহলে ইসলামের অবিস্মরণীয় সিপাহ সালারের অপমৃত্যুর দায় আমার কাঁধে চাপবে সুলতান! আমি আল্লাহর কাছেও তো কোন জবাব দিতে পারবো না সুলতান! বললেন চিকিৎসক।
আর কেউ না দেখলেও আল্লাহ ঠিকই দেখছেন শাইখ! আপনি আপনার দায়িত্ব পালন করেছেন। আপনার কাছে আমার অনুরোধ, আমার অসুখের ব্যাপারটি গোপন রাখবেন। কারণ আমার শত্রুরা যদি আমার অসুখের খবর জেনে ফেলে, তাহলে তারা আমার মৃত্যুর জন্য আমার মোকাবেলা না করে অপেক্ষা করতে শুরু করবে, আমি ওদের সাক্ষাত পাবো না ।
আমার লাশ যখন দাফনের জন্যে নেয়া হবে, তখন ওরা আমার রাজ্যে আক্রমণ করে বসবে। এমন দুর্যোগ মুহূর্তে আমার ছেলেদের পক্ষে হয়তো ওদের প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না। শাইখুল আসফান্দ! আপনি কি দেখছেন না, সেলজুকীরা আবারো কী রকম ভয়ংকর হয়ে উঠছে? ওরা এখন গযনীর জন্যে হুমকিতে পরিণত হয়েছে।
আমি সবই দেখছি সুলতান! বললেন শাইখুল আসফান্দ!
আমাকে আরো একবার হিন্দুস্তান যেতে হবে, চিকিৎসকের উদ্দেশ্যে বললেন সুলতান। আমি যখন হিন্দুস্তান থেকে ফিরছিলাম তখন পথিমধ্যে জাঠ নামের একটি জনগোষ্ঠী আমার সেনাদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি করেছে। আমার সেনাদের পক্ষে তখন দৃঢ়ভাবে লড়াই করার মতো সামর্থ ছিলো না। এই দুর্বলতা আন্দাজ করে জাঠ দস্যুরা গেরিলা আক্রমণ করে আমার বহু সহযোদ্ধাকে হত্যা করেছে। তবুও সাহস করে আমার সেনারা ওদের কয়েকজনকে ধরে ফেলতে সক্ষম হয়। ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে আমি জেনে নিয়েছি জাঠ জনগোষ্ঠীর জীবন যাপন রীতি পদ্ধতি ও সামরিক শক্তি। ধৃতরা জানিয়েছে, জাঠ জনগোষ্ঠী সোমনাথের শিবমূর্তির পূজারী। এরা খুবই লড়াকু ও সংখ্যায় বিপুল। এরা এতোটাই শক্তির অধিকারী, ইচ্ছা করলে আশেপাশের যে কোন মহারাজার ক্ষমতা দখল করে নিতে পারে। তাছাড়া এরা মুসলমানদের জঘন্য শত্রু। এই ভয়ংকর শত্রুদের শায়েস্তা করতে আমাকে আরেকবার হিন্দুস্তানে যেতেই হবে শাইখুল আসফান্দ! আমি যদি এই বেয়াড়া জনগোষ্ঠীর কোমড় ভেঙ্গে না দেই; তা হলে এরা আবার অন্য কোন জায়গায় শিবমূর্তি দাঁড় করিয়ে দেবে, আর মুসলমানদের ধরে ধরে শিবমূর্তির পায়ে বলি দিতে থাকবে।
আপনি একটু বিশ্রাম নিন সুলতান! আমি আপনাকে ওষুধ দেবো।
শুধু দাওয়া ওষুধ) নয় দু’আও করুন শাইখুল আসফান্দ! এখন দাওয়ার চেয়ে দু’আ আমার বেশী প্রয়োজন। বললেন সুলতান মাহমুদ।
ওষুধ পত্র দিয়ে চিকিৎসক চলে যাওয়া পর সেই কক্ষে প্রবেশ করলেন সুলতানের স্ত্রী ও তার কন্যা।
চিকিৎসক কি বলে গেলেন? আপনি আমাদেরকে কক্ষ থেকে বের করে দিলেন কেন? এমন কি গোপন কথাছিলো চিকিৎসকের সাথে? এক নাগাড়ে প্রশ্ন কয়টি সুলতানের দিকে ছুঁড়ে দিলেন তার স্ত্রী।
‘হু’! চিকিৎসক বললেন, আরাম করুন। দায়িত্ব কর্তব্যের কথা ভুলে যান। বললেন সুলতান।
চিকিৎসক যদি আপনাকে বিশ্রামের কথা বলে থাকেন, তাতে নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে। মায়ের কণ্ঠ থেমে যেতেই বললেন সুলতানের কন্যা। কন্যার উদ্দেশ্যে সুলতান বললেন, চিকিৎসক বলেছে আমার শরীর নাকি খুব ভেঙে পড়েছে, বিশ্রাম নিতে হবে।
শাইখুল আসফান্দ যেভাবে বিশ্রাম নিতে বলেছেন, আপনার উচিত সেভাবেই বিশ্রাম নেয়া। বললেন সুলতানের বেগম। আমার ছেলেরা আপনার দায়িত্ব ঠিকই পালন করতে পারবে।
তা পারবে বৈকি বেগম! কিন্তু সেলজুকীদেরকে এরা শায়েস্তা করতে পারবে । হিন্দুস্তানের জাঠদের মাথা গুঁড়িয়ে দেয়াও এদের জন্যে কঠিন হবে বেগম। মরার আগে এই দু’টি কাজ করেই আমাকে মরতে হবে।
ঐতিহাসিক আলবিরুনী লিখেছেন, সত্যিকার অর্থেই তখন সুলতান মাহমূদের শরীর ভেঙে গিয়েছিল। দৃশ্যত তার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল তিনি ক্লান্ত অসুস্থ। কিন্তু তিনি শরীরের তোয়াক্কা না করে চিকিৎসক চলে যাওয়ার পর বিশ্রাম না নিয়ে সেনাকর্মকর্তাদের ডেকে পাঠালেন এবং জরুরী নির্দেশনা দিয়ে বললেন, আগামীকাল সূর্য উঠার আগেই আমি গযনীর জামে মসজিদ ও আমার বাড়ীর সদর দরজার পথে সোমনাথ থেকে আনা শিবমূর্তির টুকরো এভাবে দেখতে চাই; যাতে মানুষ এগুলো মাড়িয়ে যাতায়াত করে এবং মক্কা ও মদীনার জন্যে দু’টি টুকরো আগামীকালই পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। দ্বিতীয় দিনই সুলতান মাহমূদ হিন্দুস্তানের জাঠ উপজাতির বিরুদ্ধে সেনাভিযানে প্রস্তুতি নেয়ার জন্যে সেনাদের নির্দেশ দিলেন। সেই সাথে সৈন্য ঘাটতি পূরণে নতুন সেনা ভর্তির নির্দেশ দিয়ে তাদেরকে কঠোর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে চৌকস যোদ্ধায় পরিণত করার দিক নির্দেশনা দিলেন।
সুলতান মাহমূদ চিকিৎসকের সতর্কবাণীর পরোয়া না করে, অবসর ও বিশ্রাম নেয়ার কোন তোয়াক্কা না করে নতুন সেনা ভর্তি ও প্রশিক্ষণের প্রতি মনোনিবেশ করলেন। সেই সাথে সরকারী প্রশাসনিক কর্মকান্ডে আত্মনিয়োগ করলেন। অপর দিকে লাহোর ও মুলতানের গভর্নরের কাছে জাঠদের সম্পর্কে বিস্তারিত রিপোর্ট পাঠানোর জন্যে পয়গাম পাঠালেন।