আমার আবার কি হয়েছে? আপনি কি শুনেননি, আমি কোত্থেকে এসেছি, কি করে, কতো যাতনা সহ্য করে দীর্ঘ দিনের কঠিন সফর শেষ করেছি। সফরের এই ধকলকে আপনি অসুস্থতা বলছেন?
জী সুলতান! আমি সত্যিই বলছি, আপনি অসুস্থ। আপনার কাছে উট আর ঘোড়ার পার্থক্য করা যেমন সহজ আমার কাছে সুস্থ ও অসুস্থতার ব্যবধান অনুধাবন করা এমনই সহজ।
এ সময় সুলতানের বেগম সাহেবা এবং তার এক কন্যা পাশে দাঁড়ানো ছিলেন। চিকিৎসকের কণ্ঠে অসুখের কথা শুনে তারা জানতে চাইলেন- কি রোগ হয়েছে সুলতানের? চিকিৎসক তাদের আশ্বস্ত করতে বললেন, না তেমন মারাত্মক কিছু নয়।
সুলতান স্ত্রী ও কন্যার উদ্দেশ্যে বললেন, আরে তোমরা শুধু শুধু দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। এ কিছু না। সফরের ক্লান্তি আর কি? যাও তোমরা এ ঘর থেকে চলে যাও, আমি চিকিৎসকের সাথে কিছু প্রশাসনিক কথা বলবো।
স্ত্রী ও কন্যা সেই কক্ষ থেকে চলে যাওয়ার পর সুলতান চিকিৎসককে জিজ্ঞেস করলেন, আমার কি রোগ হয়েছে শাইখুল আসফান্দ?
আপনার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বিনষ্ট হয়ে গেছে সুলতান! আমি বহু আগেই এ ব্যাপারে আপনাকে সতর্ক ও অবহিত করেছি সুলতান! এখন প্রায়ই আপনার বুকে ব্যথা হয়, কণ্ঠনালী ফুলে যায় তা কি আপনি অনুভব করেন না সুলতান?
আমি আপনাকে ভয় দেখানোর জন্যে বলছি না, শুধু সতর্ক করার জন্য বলছি। কারণ, এখন থেকে সতর্ক না হলে পরবর্তীতে অবস্থা আরো শোচনীয় হয়ে পড়বে। আপনার যক্ষ্মা রোগ হয়েছে সুলতান। তবে এটা এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে।
আরে যক্ষ্মা রোগ আমার কি আর বিগড়াবে?
সম্মানিত সুলতান! এটাকে আপনি শরীরের ঘুণ পোকা মনে করতে পারেন। ঘুণ পোকা যেমন ভেতর থেকে কাঠ খেয়ে শেষ করে ফেলে, যক্ষ্মা রোগও তেমনি দেখা যায় না কিন্তু ভেতরে ভেতরে শরীরের সবকিছুকে নষ্ট করে দেয়। এখন থেকে যদি আপনি কঠিন পরিশ্রমের কাজ না করে পূর্ণ বিশ্রামে থাকেন এবং মাথা থেকে সব জটিল চিন্তা দূর করে দেন তাহলে আশা করা যায় রোগটি আর বাড়বে না। বর্তমানে আপনার শরীরের কাঠামো ভেঙে যাচ্ছে।
আপনি কি আত্মিক শক্তিতে বিশ্বাস করেন? শাইখুল আসফান্দ?
আত্মিক শক্তিতে আমি অবশ্যই বিশ্বাস করি সুলতান। কিন্তু আত্মিক শক্তি ততোক্ষণই সক্রিয় থাকে যতক্ষণ দেহ আত্মাকে ধারণ করার সামর্থ রাখে । দেহ আত্মাকে ধারণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেললে আত্মা দেহ পিঞ্জিরার বাঁধন ছিঁড়ে বেরিয়ে যায়।
আমি হিন্দুস্তানের এমন সব যোগী সন্ন্যাসীকে দেখেছি, যাদের আত্মিক ক্ষমতা এতোটাই বিস্ময়কর যে, সাধারণ মানুষ সেইসব ক্ষমতাকে অপার্থিব বলে বিশ্বাস করতে শুরু করে। যোগীরা আমাকে বলেছে, এ ধরনের ক্ষমতা ইচ্ছা করলে যে কেউ অর্জন করতে পারে। যোগীদের চেয়ে কি আমার আত্মশক্তিকে হীন মনে করেন আপনি? চিকিৎসকের উদ্দেশ্যে বললেন সুলতান।
সম্মানিত সুলতান! আপনি যাই বলুন না কেন, আমি তবুও বলবো, যক্ষ্মা যদি আপনার শরীরকে ভেতর থেকে ফোকলা করে ফেলে তবে সেই আত্মিক শক্তি কোত্থেকে পয়দা হবে?
দৈহিক শক্তি নয় আত্মিক শক্তির বলেই আমি সোমনাথের মতো কঠিন যুদ্ধ জয় করেছি এবং ভয়ংকর যন্ত্রণাদায়ক দীর্ঘ সফরও করেছি। আমার মনে আছে সোমনাথ অভিযানে যাওয়ার আগেই আপনি আমাকে বিশ্রাম নেয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তখন হয়তো আমাকে পরীক্ষা করে আপনি এই রোগের উপস্থিতি ধরতে পারেননি। আসলে রোগটি তখনও আমার মধ্যে ছিলো। এখন আপনি এটিকে স্বনামে চিহ্নিত করতে পেরেছেন। অবশ্য আমি এটাকে একটা সাধারণ রোগই মনে করে আসছি। আজ আমি আপনার কাছ থেকে একটা প্রতিশ্রুতি নিতে চাই শাইফুল আসফান্দ! আমার এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার কথাটি কেউ যেনো জানতে না পারে।
এখনও পর্যন্ত আমি এটাকে যক্ষাই বলছি সুলতান! কিন্তু আমার আশংকা হচ্ছে এটা পাকস্থলীর রোগ। যদি তাই হয় তবে কিছু দিনের মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়বে, তখন পরিষ্কার বোঝা যাবে এটি যক্ষ্মা না পাকস্থলীর রোগ। তবে আমি আপনাকে করজোড়ে নিবেদন করছি, এখন থেকে আপনি নিয়মিত বিশ্রাম, ওষুধ ও পথ্যের প্রতি মনোযোগী হবেন।
‘আরে শাইখ!’ আমি মরে গেলে কি আর ক্ষতি হবে। আমার ছেলেরা এখন বড় হয়েছে, আশা করি তারা সালতানাতকে সামলে নিতে পারবে।
আপনার খান্দানে সালতানাত চালানোর মতো লোকের অভাব হবে না। আরো বহু সুলতান হয়তো জন্ম নেবে কিন্তু মাহমূদ আর কেউ হবে না। আর কোন মূর্তি সংহারী জন্ম নেবে না। সবাই হয়তো আল্লাহ ও রাসূলের নামের উপরই সালতানাত চালাবে কিন্তু আল্লাহর নামে নিজেকে উৎসর্গ করার মতো শাসক আর পাওয়া যাবে না। হিন্দুস্তানের পাথুরে ভগবানদের টুকরো করে এনে গযনী শাহী মসজিদের পথে ছড়িয়ে দেয়ার শক্তি আর কারো হবে না। আমি আপনার ব্যক্তি স্বার্থে নয়, আপনার পরিবার, রাজত্ব কিংবা শাসন কার্যের স্বার্থে নয় ইসলামের স্বার্থে মুসলিম বিশ্বের মর্যাদার স্বার্থে আপনাকে আরো কিছুদিন জীবিত ও সক্ষম দেখতে চাই সুলতান!
জন্মমৃত্যু কোন মানুষের হাতে নয়, শাইখুল আসফান্দ! বললেন সুলতান মাহমূদ। আমাকে দুনিয়াতে আরো বহু কাজ করতে হবে। মুসলিম বিশ্বের প্রতি কতিপয় কেউটে সাপ উঁকি ঝুঁকি মারছে। হিন্দুস্তানের কালনাগিনী গুলোকেও আমার বিনাশ করতে হবে। এতোগুলো আক্রমণের পরও হিন্দুস্তানের কালনাগিনীগুলোকে নিঃশেষ করা সম্ভব হয়নি। সোমনাথ অভিযানে গিয়ে আমি হিন্দুস্তানের উপকূলীয় এলাকায় মুহাম্মদ বিন কাসিমের সময়কার মুসলমানদের উত্তরসূরীদের দেখেছি।