* * *
তখনও গযনী বাহিনীর কষ্টের শেষ হয়নি। এবার তারা অজানা অচেনা পথে কোন জানাশোনা গাইড ছাড়াই অগ্রসর হচ্ছিল। এখন রাতের বেলা আসমানের তারা আর দিনের বেলা সূর্যই ছিলো তাদের পথ চেনার উপায়।
দু’দিন এভাবে চলার পর তারা একটি পল্লীর দেখা পেলো এবং স্থানীয় এক লোককে গাইড হিসেবে সাথে নিল। এই অজানা অচেনা গাইড গয়নী বাহিনীকে সিন্ধু নদীর এমন কূলে নিয়ে গেল যেখানে নদীর গভীরতা ও প্রশস্ততা ছিলো
অনেক বেশী।
এই গাইড সিন্ধু নদীর তীর ঘেঁষে কাফেলাকে একটি জটিল এলাকায় নিয়ে গেল আর সেখানে পৌঁছতেই সন্ধ্যা নেমে এলো। বাধ্য হয়েই গযনী বাহিনী সেখানে রাতযাপনের জন্য তাঁবু ফেললো। কিন্তু গভীর রাতে গযনী শিবিরে শুরু হয়ে গেল হৈ চৈ কোলাহল। পরিস্থিতি আঁচ করে সুলতান গাইডকে তলব করলেন, কিন্তু গাইডকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া গেলো না। কিছুক্ষণের মধ্যেই জানা গেলো, শিবিরের একটি অংশে অজ্ঞাত লোকেরা হামলা করেছিল । কিন্তু সতর্ক গযনীর সেনারা আক্রমণকারী কয়েকজনকে ঘেরাও করে ধরে ফেলতে সক্ষম হয় এবং তাদের কয়েকজন আহত হয়েও পালানোর শক্তি হারিয়ে ফেলে। ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেলো, এই এলাকাটি হিন্দু জাঠদের এলাকা হিসেবে পরিচিত। এলাকাটি আমরকোটের অংশ। ধৃত জাঠরা জানালো, তাদের একটা ছোটখাটো রাজত্ব আছে। জাঠরা খুবই দুঃসাহসী লড়াকু। লুটতরাজ করাই তাদের প্রধান পেশা।
ধৃতজাঠরা আরো জানালো, তাদের রাজা জানতে পেরেছিল গযনী বাহিনী সোমনাথ ধ্বংস করে সেখানকার সব সোনাদানা নিয়ে যাচ্ছে। ফলে সেই রাজাই এই গাইডকে কৌশলে পাঠিয়েছিলো। গাইড রাজার নির্দেশ মতো গযনী বাহিনীকে আক্রমণের উপযোগী জায়গায় এনে রাতের অন্ধকারে গায়েব হয়ে যায়। পরদিন দিনের বেলায় গযনী বাহিনী যখন রওয়ানা হলো, হঠাৎ পেছন দিকে জাঠদস্যুরা অতর্কিতে আক্রমণ করে দ্রুত ঘোড়া হাঁকিয়ে পালিয়ে গেলো। এভাবে কয়েকবার আক্রান্ত হওয়ার পর সুলতান কাফেলার গতি থামিয়ে ধৃতজাঠদের এনে জিজ্ঞেস করলেন, জাঠদের রাজধানী এখান থেকে কতোটা দূরে? ধৃত জাঠরা জানালো, ‘জাঠদের নির্দিষ্ট কোন রাজধানী নেই। আপনি জাঠদের ধ্বংসের পেছনে পড়লে লজ্জিত হবেন। কারণ তারা কোথাও এক জায়গায় এক সাথে থাকে না। দুর্গ বা স্থায়ী নিবাস তৈরীও তাদের স্বভাব বিরোধী।
সুলতানের মনোভাব বুঝে তার সেনাপতিগণ তাকে পরামর্শ দিলেন, গযনীর সেনা সংখ্যা অনেক কমে গেছে। তাছাড়া দীর্ঘ কষ্টকর সফরের কারণে অবশিষ্ট সেনাদের মধ্যে দৃঢ়ভাবে লড়াই কিংবা আক্রমণাত্মক ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার সামর্থ নেই। এই এলাকার ভৌগোলিক অবস্থা ও জনমানুষ সম্পর্কে আমাদের কোনই ধারণা নেই। জানা নেই এখানে আমরা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে পরিণতি কি হয়? এমতাবস্থায় ধৃতকয়েদীদের উপরও ভরসা রাখা কঠিন। তাই যথাসম্ভব দ্রুত আমাদের উচিত গযনী পৌঁছার চেষ্টা করা।
সুলতান সেনানায়কদের যৌক্তিক পরামর্শ ও বাস্তবতা মেনে নিলেন। কিন্তু জাঠদের পরপর আক্রমণে বিপর্যস্ত গযনী সেনাদের প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির মোকাবেলা করতে না পারায় সুলতান রাগে ক্ষোভে দাঁতে দাঁত কামড়ে ক্ষোভ হজম করতে বাধ্য হলেন।
* * *
সোমনাথ জয় করে অজানা পথে গযনী পৌঁছতে গযনী বাহিনীর যে দুঃসহ যন্ত্রণা, অজানা শত্রুদের গেরিলা আক্রমণ এবং অচেনা মরুভূমিতে টানা ছয় সাতদিন পানিহীন পিপাসায় ছটফট করতে হয়েছে, যে কষ্ট সহ্য ও ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে এই কুরবানী ও ক্ষয়ক্ষতি ছিলো যে কোন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের চেয়েও আরো বেশী। দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর ফিরতি সফর শেষে ১০২৬ সালের ৬ এপ্রিল মোতাবেক ৪১৭ হিজরী সনের ১০ সফর সুলতান মাহমূদ সোমনাথ জয়ী বেঁচে থাকা সেনাদের নিয়ে গযনী পৌঁছেন। গযনীর সীমানায় পৌঁছা মাত্রই তিনি ঘোড়া থেকে নেমে দু’রাকাত শোকরানা নামায আদায় করলেন। এ নামায যুদ্ধ জয়ের জন্য নয় বহু ত্যাগ জীবনহানি ও সম্পদ হারিয়ে হলেও আল্লাহ তাআলা যে বিজয়ী কাফেলাকে শেষ পর্যন্ত গযনী পৌঁছার তওফিক দিয়েছেন এ নামায ছিলো এরই কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য।
সেনাদের সোমনাথ জয় করে আসার খবর শুনে গোটা গযনীর আবাল বৃদ্ধ বণিতা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আনন্দে মেতে উঠলো। মহিলারা বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে বিজয়ী সেনাদের কাপড় নেড়ে অভ্যর্থনা জানাচ্ছিল। ছোট শিশুরা আনন্দে নেচে গেয়ে উল্লাস প্রকাশ করছিল।
গযনী ফিরে রাতের বেলায় সুলতান মাহমূদ তার দেহে অস্বাভাবিক ক্লান্তি ও অবসাদ অনুভব করলেন। অবশ্য ক্লান্তি এর আগেও তার অনুভূত হতো কিন্তু এবার তার মনে সাক্ষ্য দিচ্ছিল তার শরীর কেমন যেন নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। প্রত্যেকবার যুদ্ধ থেকে ফেরত আসার পর সুলতানের একান্ত চিকিৎসক তার শারীরিক অবস্থা পর্যালোচনা ও পরীক্ষা করতেন। চিকিৎসক এবারও রাতের বেলায় এসে সুলতানের দেহের অবস্থা জানার জন্য তার রক্ত সঞ্চালন বুঝতে হাতের নার্ভ টিপে ধরলেন। এর পর বুকের হৃদকম্পন বুঝার জন্য বুকে হাত রাখলেন। সুলতানকে নানা প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন। সবকিছু বুঝে শুনে চিকিৎসকের কপালে ভাঁজ পড়লো। চিকিৎসক সুলতানের দেহের নাজুক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তিনি সুলতানকে বললেন- সম্মানিত সুলতান! আপনার দেহের অবস্থা দেখে আমি যতোটা চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছি, এমন চিন্তা আপনার মধ্যে দেখা গেলে আপনার দৈহিক অবস্থার কখনো অবনতি ঘটতো না। আপনি খুবই অসুস্থ সুলতান! কমপক্ষে আপনাকে এক বছর বিরতিহীন বিশ্রাম নিতে হবে।