পঞ্চম দিন সেনাদের অধিকাংশই তৃষ্ণা পিপাসায় কাতর হয়ে গেল। অনেকের মাথা চক্কর দিতে লাগল। ঘোড়াগুলো হারিয়ে ফেলল ১লার শক্তি। সুলতান মাহমূদ প্রধান সেনাপতি আবু আব্দুল্লাহ ও সেনাপতি আবুল হাসানকে বললেন, আমার কেন যেন গাইডদের ব্যাপারে সন্দেহ হচ্ছে, ওদের ডেকে আনো। পিপাসায় দুই গাইডেরও মাথা দুলছিল। তাদেরকে সুলতানের সামনে হাজির করা হলে সুলতান তাদের জিজ্ঞেস করলেন–
তোমরাও তো পিপাসায় কষ্ট পাচ্ছো, তোমাদের অবস্থা তো আমাদের সেনাদের চেয়ে আরো খারাপ, তোমরা বলছিলে এই মরুভূমিতে পানির অভাব নেই। কোথায় পানি?
পানি ঠিকই আছে সুলতান! তবে পানি পর্যন্ত আপনাদের পক্ষে জীবন নিয়ে পৌঁছা সম্ভব নয়। জবাব দিলো এক গাইড।
তোমরা কি জেনে শুনেই আমাদেরকে পানি থেকে দূরে নিয়ে এসেছো?
জী হ্যাঁ সুলতান! আমরা জেনে বুঝেই একাজ করেছি।
তাহলে তোমরা কি আমাদেরকে বিপথে নিয়ে আসার জন্যেই গাইড সেজেছিলে? তোমরা কি জানো না, তোমাদের এই অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড?
আমরা বিলক্ষণ তা জানতাম সুলতান! আমরা শিবদেবের সম্মানে আমাদের জীবন উৎসর্গ করেই সোমনাথ থেকে রওয়ানা হয়েছিলাম। আপনার কি মনে নেই, যখন মহারাজা দেবআশ্রম আপনাকে রাস্তার কথা বলছিলেন, তখন পাশে থাকা রাণী বলেছিলেন, তিনি আপনাকে এমন গাইড দেবেন, যারা আপনাকে এমন পথে নিয়ে যাবে যেপথে পানির কোন অভাব নেই। তিনি অবশ্য আপনার সাথে ওয়াদা করেছিলেন আপনাকে সৎ পথপ্রদর্শক দেবেন। কিন্তু আমরা দুজন তার ওয়াদাকে ভঙ্গ করে আপনাদেরকে পানি থেকে দূরে নিয়ে এসেছি। আমরা রাজা দেবআশ্রমের সাথে সোমনাথ রক্ষার্থে আপনার বিরুদ্ধে লড়াই করতে এসেছিলাম কিন্তু আমরা সোমনাথ পৌঁছে দেখি সোমনাথের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। এরপর আমরা একটি রাতও ঘুমাতে পারিনি। বহুবার আপনাকে হত্যার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কোন সুযোগ পাইনি। অবশেষে যখন শুনলাম, আপনার গাইডের দরকার, তখন আমরা নিজেরাই স্বেচ্ছায় আপনাদের গাইড হওয়ার জন্য নিজেদের পেশ করলাম এবং খুব সাফল্যের সাথেই আমরা আমাদের কাজ করতে পেরেছি। আমরা শুধু আপনাকে নয়, আপনার গোটা বাহিনীকেই পানি থেকে দূরে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি। এখন আপনার গোটা বাহিনীর বিরুদ্ধেই আমরা প্রতিশোধ নিতে পেরেছি। আগামীকাল পানির অভাবে আমরা এমনিতেই মরে যাব। কাজেই আপনার মৃত্যুদণ্ড বরং আমাদের মৃত্যুকে আরো সহজ করবে কিন্তু আপনার গোটা বাহিনীকেই জীবন দিয়ে সোমনাথ ধ্বংসের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।
সুলতান তাৎক্ষণিক এই দুই নরাধমকে হত্যার নির্দেশ দিলেন। দুই সেনা। কর্মকর্তা সাথে সাথে তরবারী দিয়ে ওদের মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিল।
***
দুই গাইড যা বলেছিলো তা ছিলো খুবই বাস্তব। সত্যিকার অর্থেই গোটা বাহিনীর অবস্থা পানির অভাবে শোচনীয় হয়ে উঠেছিল। অধিকাংশ সেনা ক্ষুধা তৃষ্ণায় দুলছিল, কারো কারো শুরু হয়ে গিয়েছিল মৃত্যুযন্ত্রণা।
ষষ্ঠ দিন শেষে রাতের বেলায় সেনা শিবিরের ঘোড়াগুলো তৃষ্ণায় ছটফট করছিল আর আর্তচিৎকার করে হ্রেষারব করছিল। ভারবাহী উটগুলোর গতিও শ্লথ হয়ে এসেছিল। সেনারা ঘোড়া ও উটের উপর বসে থাকার সামর্থটুকুও হারিয়ে ফেলেছিল। সুলতান এশার নামাযের পর এমন করুণ অবস্থার মধ্যে শিবিরের বাইরে খোলা জায়গায় এসে কয়েক রাকাত নফল নামায পড়লেন। নামাযরত অবস্থায়ও সুলতানের কানে ভেসে আসছিল পিপাসার্ত উট ঘোড়া ও সেনাদের আর্তচিৎকার। অনেক সেনার কণ্ঠের আওয়াজ ক্ষীণ হয়ে গিয়েছিল। তারা যেন কান্নার সামর্থটুকুও হারিয়ে ফেলেছিল।
সুলতান গোটা সেনাবাহিনীও ভারবাহী জন্তুদের করুণ অবস্থা সামনে রেখে আল্লাহর দরবারে দু’হাত তুলে মোনাজাত শুরু করলেন। সুলতান এতোটাই কাঁদলেন যে, এক পর্যায়ে তার কণ্ঠ থেকে আর কোন আওয়াজ বের হচ্ছিল না। কারণ, তিনি জানতে, আজ রাতে যে সেনারা তার সাথে আছে এভাবে পানিহীন অবস্থা থাকলে আগামী রাতে হয়তো তাদের অর্ধেকও বেঁচে থাকবে না।
সুলতানের দু’আ শেষ হতেই রাতের অন্ধকার আকাশে হঠাৎ একটি তারা ভেঙে পড়লো এবং অন্ধকার ভেদ করে একটি আলোর ঝলক একদিকে নেমে হারিয়ে গেলো। তা দেখে সুলতানের কণ্ঠে উচ্চারিত হলো, আল্লাহ তাআলা আমাদের ইশারা দিয়েছেন, আগামীকালের মধ্যেই ইনশাআল্লাহ আমরা পানির দেখা পাবো।
মরুভূমিতে এ কয়দিন তারা কোন পাখি উড়তে দেখেনি। কিন্তু সকাল বেলায় সুলতানের কানে উড়ন্ত পাখির কলরব ভেসে এলো । সুলতান আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলেন এক ঝাক পাখি উড়ছে। তিনি পাখির ঝাকের দিকে এক পলকে তাকিয়ে রইলেন। দেখলেন পাখির ঝাকটি অনেকটা দূরে গিয়ে নীচে নেমে গেছে। সুলতান উচ্চ কণ্ঠে বলে উঠলেন, এগুলোই পানির পাখি । পাখিগুলো সেদিকেই গেছে। যেদিকে তারা ভেঙে পড়েছিল। সুলতান সূর্যের আলো প্রখর হওয়ার আগেই সবাইকে ওদিকে রওয়ানা হওয়ার নির্দেশ দিলেন।
প্রায় দ্বিপ্রহরের আগে আগে যখন গোটা কাফেলার অবস্থাই সঙ্গীন, বহু সেনার মধ্যে মৃত্যুযন্ত্রণা শুরু হয়ে গেছে ঠিক তখন তাদের নজরে এলো পানির অস্তিত্ব। এ পানি পানি নয়, রীতিমতো একটি ঝিল। ঘোড়াগুলো পানির গন্ধ পেয়ে লাগামহীন হয়ে পানির দিকে দৌড় দিলো। সেনারা অনেকেই পানিতে মাথা ভিজিয়ে শরীরে পানি ছিটালো আর প্রাণভরে পানি পান করে তৃষ্ণা নিবারণ করল। কাফেলার সকল প্রাণি ও সেনা তৃপ্তিভরে পানি পান করে বিশ্রামের জন্য সেখানেই তাঁবু ফেললো এবং অবশিষ্ট দিন ও রাত আহারাদী সেরে বিশ্রাম করে শরীরটাকে তাজা করে নিল। সেই সাথে প্রত্যেকের সামর্থানুযায়ী পানি সাথে করেও নিয়ে নিলো।