.
সুলতান মাহমুদের গোয়েন্দা শাখা স্থানীয় কয়েকজনকে গোয়েন্দা বিভাগে নিয়োগ দেয়। তারা জানায়, যেসব সেনা গযনী বাহিনীর উপর পেছন দিক থেকে আক্রমণ করেছিলো, তাদের নেতৃত্ব দিয়েছিলো রাজা পরমদেব। এই আক্রমণ প্রতিহত করতে গিয়ে গযনী বাহিনীর তিনহাজার সেনাকে প্রাণ দিতে হয়েছে। স্থানীয় গোয়েন্দারা জানালো, সোমনাথ থেকে একশ বিশ মাইল উত্তরে গভী নামক স্থানে রাজা পরমদেবের রাজধানী অবস্থিত। গভী চারদিক থেকে সাগর বেষ্টিত।
এই আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে সুলতান মাহমূদ এতোটাই ক্ষুব্ধ ছিলেন যে, তিনি তাৎক্ষণিক গভী অভিযানের নির্দেশ দিলেন। সুলতান সেখানে পৌঁছে দেখলেন, গন্দভী দুর্গে পৌঁছা কিছুতেই সম্ভব নয়। কারণ চতুর্দিকেই অথৈই পানি। অবশ্য একপাশে পানি কিছুটা কম। আরো খবর পাওয়া গেলো, পরমদেব নিজেই নিজেকে দুর্গবন্দী করে রেখেছে।
আবুল কাসিম ফারিশতা লিখেছেন, একরাতে সুলতান মাহমুদ কুরআন কারীম তেলাওয়াত করলেন। কিছু বিশেষ আয়াত পাঠ করে আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করে সাহায্যের জন্য মোনাজাত করলেন। পরদিন সকালে দেখা গেলো, সমুদ্রের পানি অনেক কমে গেছে। যেদিকে পানি কমছিল সেদিকের এলাকাটিতে পানি নেই বটে, কিন্তু অনেক কাদা। সুলতান তার সেনাদেরকে কাদার মধ্য দিয়ে অভিযানের নির্দেশ দিলেন এবং নিজেও সেনাদের সাথে দুর্গের কাছে পৌঁছে গেলেন।
গয়নী বাহিনী দুর্গে আক্রমণ পরিচালনার কিছুক্ষণের মধ্যেই দুর্গফটক খুলে গেল। দুর্গে প্রবেশ করে জানা গেল, রাজা পরমদেব সমুদ্রপথে পালিয়ে গেছেন। গভীর হিন্দু সেনা সোমনাথ যুদ্ধে গযনী বাহিনীর ভয়ঙ্কর আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে হাজার হাজার সহযোদ্ধাকে হারিয়ে মাত্র কিছুসংখ্যক প্রাণ নিয়ে গভীতে পালিয়ে আসতে পেরেছিল। এরা এমনিতেই ছিলো হতোদ্যম হীনবল। তারা প্রতিরোধের কোন চেষ্টা না করেই আত্মসমর্পণ করলো। সুলতান গন্ধভী দুর্গ লোকশূন্য করার নির্দেশ দিলেন।
সুলতান এ দুর্গে কিছুদিন অবস্থান করলেন। জায়গাটি ছিলো বর্তমান গুজরাট রাজ্যের অন্তর্গত। এখানকার আবহাওয়া ছিলো খুবই স্বাস্থ্যকর এবং পরিবেশ খুবই মনোমুগ্ধকর। সুলতানের জায়গাটি খুব পছন্দ হলো। তিনি এটি গযনী সালতানাতের কেন্দ্রীয় রাজধানী করার মত ব্যক্ত করলেন।
সুলতান তার ছেলে মাসউদকে বললেন, তুমি গযনী চলে যাও। সেখানকার প্রশাসনের দায়িত্ব তোমার হাতে নাও, আমি এখানেই থাকতে চাই।
আপনি এখানে থেকে গেলে সেলজুকী ও খোরাসানীরা কি বলবে না সুলতান মাহমূদ ময়দান ছেড়ে পালিয়ে গেছে? বললেন মাসউদ। অথচ বহু রক্ত ক্ষয়ের বিনিময়ে আমরা খোরাসান জয় করেছি।
আপনি এখানকার কোন স্থানীয় লোককে এই অঞ্চলের গভর্নর নিযুক্ত করুন সুলতান! প্রস্তাব করলো সুলতানের এক উপদেষ্টা। কারণ গযনীর অবস্থা এমন যে, আপনার অনুপস্থিতিতে তার কেন্দ্রীয় মর্যাদা ও গুরুত্ব ধরে রাখতে পারবে না।
অনেক চিন্তা ভাবনা করে অবশেষে উপদেষ্টাদের পরামর্শ মেনে নিলেন সুলতান। তিনি পুনরায় সোমনাথ দুর্গে ফিরে গেলেন। যথেষ্ট যাচাই বাছাই করে অবশেষে রাজা দেবআশ্রমকে সোমনাতের গভর্নর নিযুক্ত করে তিনি গযনী ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে সেনাদের নির্দেশ দিলেন।
সুলতান নবনিযুক্ত গভর্নর দেবআশ্রমকে জানালেন, তিনি মুলতানের পথে ফিরে যেতে চান না। অন্য কোন সহজগম্য ও কম দূরত্বের পথে তিনি গযনী ফিরতে চান, তবে তার অন্য কোন পথ জানা নেই।
গভর্নর দেবআশ্রম সুলতানকে রানকোচ হয়ে বেলুচিস্তানের মাঝ দিয়ে গযনী যাওয়ার পথের কথা জানালেন। কারণ বেলুচিস্তান পৌঁছে গেলে সুলতান সহজেই গযনী পৌঁছতে পারবেন।
এ সময় রাজা দেবআশ্রমের রানী সেখানে উপস্থিত ছিল। রানী বললো, আমরা সুলতানকে এমন দুজন গাইড দেবো যারা সহজেই আপনাদের নিয়ে যেতে পারবে। কারণ রানকোচের পর যে মরু এলাকা সেখানকার অবস্থা সম্পর্কে অনবহিত লোকের পক্ষে পানির উৎস খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়।
* * *
বিজয়ী আবেশে ফিরে যাচ্ছিল গযনী বাহিনী। তাদের সংখ্যা অনেক কমে গিয়েছিল। দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে কয়েক হাজার সহযোদ্ধাকে হারিয়ে ছিল গযনী সেনারা। সহযোদ্ধাদের লাশগুলো সোমনাথ দুর্গের বাইরে একটি খোলা জায়গায় গণকবর দেয়া হয়। বহু আহত যোদ্ধাও ছিল কাফেলায়। ছিলো মাল পত্র ও মালে গযনীমত বোঝাই বহুসংখ্যক উট। সাধারণ যোদ্ধারা এখন আর তাকবীর ধ্বনী দিচ্ছিল না, তারা সমস্বরে রণসঙ্গীত গেয়ে সানন্দে পথ অতিক্রম করছিল। সোমনাথ যাওয়ার পথে তারা যে ভয়ঙ্কর মরুভূমি অতিক্রম করেছিলো, এই মরু ভয়াবহতার কথা তাদের আজীবন মনে থাকবে। এখনও তাদের সামনে ছিল জীবনহরণকারী মরুভূমি কিন্তু বিজয়ানন্দের উষ্ণতায় তাদের মধ্যে মরুকষ্টের যাতনা ছিলো না।
পথ চলতে চলতে বিজয়ী গযনী বাহিনী ভয়ঙ্কর মরুতে প্রবেশ করল । তিনদিন মরুর মধ্যেই তাদের চলে গেছে কিন্তু এর মধ্যে কোথাও এক ফোঁটা পানির সন্ধান পাওয়া গেল না। এবার সুলতান মাহমূদ সেনাদেরকে বেশী করে পানি বহনের নির্দেশ দেননি। ফলে সেনারা তাদের আহারের জন্যে যে পরিমাণ পানি সঙ্গে এনেছিল তা ফুরিয়ে গেছে। ঘোড়া ও উটগুলো পিপাসার্ত হয়ে পড়েছিল। হিন্দু রাজা তাদের পথ দেখিয়ে নেয়ার জন্য যে দুজন গাইড দিয়েছিল এরা আশ্বাস দিয়েছিল এমন পথে কাফেলাকে নিয়ে যাবে, যে পথে অঢেল পানির উৎস রয়েছে। গাইডদের যখন জিজ্ঞাসা করা হলো, পানি কোথায়? তারা আশ্বাস দিলো আগামীকাল নিশ্চয়ই আমরা পানির কাছে পৌঁছে যাবো। কিন্তু চতুর্থ দিনও এভাবেই তপ্ত মরুর মধ্যেই কেটে গেলো পানির দেখা পাওয়া গেল না।