এ যুদ্ধে সোমনাথ ও বাইরে থেকে আসা যোদ্ধারা মিলে প্রায় পঞ্চাশ হাজার হিন্দু নিহত হয়। প্রায় চার হাজার হিন্দু সমুদ্রপথে পালাতে চেষ্টা করে কিন্তু তাদের অনেকেই তীরাঘাতে নিহত হয়। কেউ সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে মারা যায়। নৌকা উল্টে অনেকের সলিল সমাধি ঘটে।
১০২৬ সালের ৯ জানুয়ারি ৪১৭ হিজরী সনের ১৬ যিলহজ্জ সোমনাথ মন্দির সুলতান মাহমূদের করতলগত হয়।
* * *
বিজয়ী সুলতান সোমনাথ মন্দির এবং মন্দিরের কারুকার্য দেখে অভিভূত হন। তখনকার সোমনাথ মন্দির ছিলো ভারতীয় স্থাপত্য শৈলীর অনুপম নিদর্শন। সোমনাথ মন্দিরের সিঁড়িতে হাজারো পুরোহিত পণ্ডিত হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ। সুলতান পণ্ডিতদের এমন অবস্থা দেখে দুভাষীর মাধ্যমে বললেন, ওদেরকে বলো হাত গুটিয়ে নিতে, আমি সোমনাথের মূর্তি নই। এদের বলে দাও, তাদের উপর কোন অত্যাচার করা হবে না।
সুলতান মন্দিরের সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠতে উঠতে এক প্রহরীকে একটি সামরিক অস্ত্রভাণ্ডারের কুড়াল আনার নির্দেশ দিলেন। এরপর তিনি মন্দিরের মূলবেদিতে আরোহণ করে মন্দিরের প্রধান শিবমূর্তির নাক ভেঙ্গে ফেললেন। সেনাদের নির্দেশ দিলেন, এই মূর্তিটিকে ভেঙ্গে ফেলো। সমবেত হাজার হাজার পণ্ডিত পুরোহিত আর্তচিৎকার করে উঠলো। শীর্ষস্থানীয় পুরোহিতেরা সুলতানের কাছে শিবমূর্তি না ভাঙ্গার জন্যে অনুরোধ করলো। তারা সুলতানের পায়ে পড়ে নিবেদন করলো, মন্দিরের সকল গোপন ভাণ্ডার আমরা আপনার পায়ে লুটিয়ে দেবো, দয়া করে এই শিবমূর্তি ও মন্দির অক্ষত রাখুন।
সুলতান ক্ষুদ্ধ কণ্ঠে তাদের বললেন, গযনীর হাজার হাজার মায়ের বুক খালি করে এবং বোনকে বিধবা ও শিশুকে এতিম করে আমি এখানে সওদা করতে আসিনি। কোন কোন ঐতিহাসিক বলেছেন, সুলতানের দুই সেনাপতিও তার বড় ছেলে মাসউদ পণ্ডিতদের আবেদন মেনে নেয়ার জন্য সুলতানকে প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু সুলতান তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বললেন, তোমরা কি আমার আখেরাত বরবাদ করে দেয়ার চেষ্টা করছো? আমি চাই, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা আমাকে ডেকে বলুন, সবচেয়ে বড় মূর্তি সংহারী কোথায়? তাকে হাজির করো। আল্লাহ তাআলা যেন এভাবে না ডাকেন, সোনাদানার বিনিময়ে যে মূর্তিপূজারীদের মূর্তিদান করেছিলো সেই ব্যবসায়ী মাহমূদকে আমার সামনে হাজির করো। এই আহ্বানকে আমি ভয় পাই। ইতিহাস আমাকে মূর্তিপূজা সহায়ক না বলে মূর্তি সংহারী বলে অভিহিত করুক, এটা কি ভালো নয়?
সুলতান নির্দেশ দিলেন, শিবমূর্তির দু’টুকরো গযনী যাবে। একটি আমার বাড়ির সামনে রাখা হবে আর অপরটি রাখা হবে গযনী জামে মসজিদের সামনে। আর অন্য দুটি অংশ মক্কা মদীনায় পাঠানো হবে। অনেক ঐতিহাসিক লিখেছেন, সুলতানের নির্দেশ মতো শিবমূর্তির চারটি টুকরো সেভাবেই পাঠানো হয় এবং তা আজো সেভাবেই সংরক্ষিত আছে।
শিবমূর্তিকে ভেঙ্গে মন্দিরের বাইরে নিয়ে এলে সোমনাথ মন্দিরের কারুকার্যময় সেগুন কাঠের পায়ে দাহ্যপদার্থ ছিটিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হলো। মুহূর্তের মধ্যে মহাভারতের হিন্দুদের গর্ব ও ঐতিহ্যের চন্দ্রদেবতার দেবালয় আগুনের লেলিহান শিখায় জ্বলে উঠলো। বিশাল অগ্নিকুণ্ডলী ঘোয়া আর পোড়ার শব্দে হিন্দুদের দীর্ঘদিনের বিশ্বাস ছাইভস্মে পরিণত হলো। যে দেবতারা ছিলো হিন্দুদের মতে জীবনমৃত্যুর মালিক তারা আজ নিজের অস্তিত্বকেই রক্ষা করতে পারলো না।
সোমনাথের মহারাজা রায়কুমার ছিলেন নিখোঁজ। তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেলো না। সুলতান মাহমূদের সেনারা মন্দির থেকে যেসব সোনাদানা মণিমুক্তা সংগ্রহ করেছিলো বর্তমানের মূল্যে তা কয়েকশ হাজার কোটি টাকা মূল্যমান ছিলো।
মন্দির যখন জ্বলছিল, সুলতান তখন দুর্গ প্রাচীরে উঠে একটি বুরুজে দাঁড়িয়ে চারদিকের দৃশ্য অবলোকন করছিলেন। শহরের বহু জায়গা থেকে আগুনের কুণ্ডলী উঠছে। দলে দলে হিন্দু অধিবাসী ফটক গলে শহর ছেড়ে যাচ্ছে। তাদেরকে কেউ বাধা দিচ্ছে না। চতুর্দিকে রক্ত আর রক্ত। শহরের বাইরে শুধু লাশ আর লাশ। চারদিকে রক্ত আর লাশের স্তূপ। দুর্গের বাইরে অনেক আহত লোক উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে, কেউ কেউ মাথা উঁচু করে আবার পড়ে যাচ্ছে। আহতরা সবাই হিন্দু সেনা। তাদের সেবা তত দূরে থাক, যারা শহর ছেড়ে যাচ্ছে, তারা আহত সেনাদের তাকিয়ে দেখারও প্রয়োজন বোধ করছে না।
গযনী সেনারা সহযোদ্ধাদের লাশগুলো উঠিয়ে এনে এক জায়গায় জড়ো করছে আর আহতদের তুলে এনে চিকিৎসার ব্যবস্থা করছে। সুলতান মাহমূদের দৃষ্টি রণাঙ্গনের চতুর্দিক পর্যবেক্ষণ করছিলো। না জানি তার মনের মধ্যে কি ভাবনা তখন বিরাজ করছিল। তিনি দেখতে পেলেন, দুর্গের ফটক পেরিয়ে দলে দলে হিন্দু নারীপুরুষ ছেলে বুড়ো কন্যা জায়া দুঃখভারাক্রান্ত মনে দুর্গ ছেড়ে যাচ্ছে। এই অবস্থা দেখে তিনি পাশে দাঁড়ানো একসেনা কর্মকর্তাকে বললেন, নীচে গিয়ে দুর্গ ফটকে ঘোষণা করে দাও, গযনীবাহিনীর অত্যাচারের ভয়ে কোন শহরবাসীকে শহর ছেড়ে যেতে হবে না। সাধারণ নাগরিকদের উপর গযনী বাহিনী কোন জুলুম করবে না। এ সময় সুলতান আপন মনেই স্বগোতোক্তি করলেন- এরা কি এখনো বুঝতে পারেনি, জয় পরাজয় জীবনমৃত্যুর মালিক এসব পাথুরে মূর্তির হাতে নয় লা শারিক আল্লাহর হাতে? তার একথার কোন জবাব কারো মুখে উচ্চারিত হলো না।