৯৪০ সালের দু’চার বছর আগে বা পরের ঘটনা। ন্যায় ও ইনসাফের প্রতীক ইরানের বাদশাহ নওশেরোয়ার শাসন অতীত হয়ে গেছে। ইরানের ক্ষমতার সিংহাসনে যারা আসীন হয়েছে ন্যায় ও ইনসাফের প্রতি তাদের চরম অনাগ্রহ। তারা ক্ষমতাপ্রিয়, ভোগ ও বিলাস-ব্যসনে মনোযোগী। তারা নিজেদের মনে করতো দেশের মালিক-মোখতার আর সাধারণ জনগণকে ভাবতো তাদের প্রজা-দাসানুদাস। প্রজাদের বেলায় ন্যায় ও আদল-ইনসাফের নীতিবাক্য তারা ছিঁড়ে ফেলে মানুষকে গোলাম-বাঁদীতে পরিণত করার সব ধরনের ব্যবস্থাই রপ্ত করেছিল। তাদের নীতি ছিল, প্রজাদের ভুখা রাখো, ওদের মুখ বন্ধ করে দাও, সত্যকে গলা টিপে মেরে ফেলে। সুবিচার ও রাজ সুবিধা ওদের দাও যারা শাসকদের গুণ গায়, রাজ্য জুড়ে তোষামুদে তৈরি কর। মোসাহেব ও তোষামোদকারীদের মধ্য থেকে উজির নাজির বানাও। প্রজাদের অবস্থা এমন করে রাখো, যাতে মানুষ কুকুরের মুখ থেকে হাড়ি ছিনিয়ে নিয়ে সন্তানের আহার যোগাতে বাধ্য হয়। ইরানের শাসকেরা বাদশাহ নওশেরোয়ার বপিত ইনসাফের বৃক্ষকে উপড়ে ফেলে দিয়ে ইরান থেকে ইনসাফ ও সুশাসন বিদায় করে ন্যায় ইনসাফের প্রতীক নওশেরোয়ার বংশধরদেরকেও ইরান ত্যাগ করতে বাধ্য করে। জুলুম ও অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে নওশেরোয়ার অধঃস্তন পুরুষেরা ইরান ছেড়ে দিগ্বিদিক ছড়িয়ে পড়ল। ক্ষমতার মসনদ থেকে ছিটকে পড়ে নওশেরোয়ার বংশধরেরা জীবন বাঁচানোর তাকিদে যে দিকে পারল বেরিয়ে পড়ল। জীবন-জীবিকার যাতনা ও দুর্ভোগ তাদের স্থান থেকে স্থানান্তরে যাযাবরে পরিণত করলো ।
যারা ছিল ন্যায়ের ঝাণ্ডাবাহী, তারা অন্যায় ও জুলুমের যন্ত্রণায় দূর দেশে পাড়ি জমাল। তাদের বয়স্করা দুনিয়া থেকে বিদায় নিচ্ছিল। শিশুরা বড় হতে লাগল অতি কষ্টে। আর এ দুরবস্থার মধ্যেই নওশেরোয়ার বংশে আরো নতুন নতুন শিশুর জন্ম হতে থাকল।
এই বংশের এক টগবগে যুবক কিবারুল হাকাম বিন কিরার আরসালান। মাঝারী গড়ন, দীপ্তিময় চেহারা চেহারায় উচ্চ বংশের ছাপ পরিস্ফুট কিন্তু দারিদ্র্যের মলিনতায় বংশীয় আভিজাত্যের পেলবতা দূরীভূত।
বুখারার এক মেঠো পথে নতুন ঠিকানার উদ্দেশে চলছে যুবক। ক্লান্ত শ্রান্ত কিরার আল হাকাম একটি গাছের ছায়ায় বসে পড়ল। জায়গাটি জঙ্গলাকীর্ণ, ঝোঁপঝাড়ে ভরপুর। কানে ভেসে আসছে ছোট শিশু-কিশোরদের হৈ চৈ। আল হাকামের দৃঢ় বিশ্বাস, ওপাশে হয়তো কোন যাযাবর দল তাবু ফেলেছে। ক্লান্ত আল হাকাম মাথার নীচে কাঁধের পুটলিটা রেখে শুয়ে পড়ল।
কচি শিঙা হৈ চৈ, খেলাধুলা ও দৌড়-ঝাপে মগ্ন হয়ে অনেক দূরে চলে গেছে। এলাকাটা নীরব নিস্তব্ধ। দুপুর গড়িয়ে তখন পড়ন্ত বেলা। গুন গুন একটি মিষ্টি আওয়াজ আল হাকামকে মুগ্ধ করল । তখনও সে বুঝে উঠতে পারছিল না, আওয়াজটা কোত্থেকে আসছে, এটি কিসের আওয়াজ! কিন্তু তার মনের কোণে আওয়াজটা হঠাই কেমন যেন নাড়া দিল। গভীরভাবে কান পেতে বুঝতে চেষ্টা করল আল হাকাম। ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে উঠলো গুঞ্জরণ। আর কিছু নয়, তিলাওয়াত। কোন নারী কন্ঠের আওয়াজ। গভীর মনোনিবেশে মনের মাধুরী মিশিয়ে তিলাওয়াত করছে কোন নারী। আওয়াজের ধরন থেকেই আল হাকাম বুঝতে পারলো, এটা বয়স্ক নারী কণ্ঠ নয়, কোন কিশোরী-যুবতীর কণ্ঠ। বেশ সুন্দর। পড়ন্ত বেলায় এই বিজন এলাকায় কিশোরীর তিলাওয়াত অপেক্ষাকৃত দূর থেকেও স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে আল হাকাম।
আল হাকাম আর শুয়ে থাকতে পারল না। শরীরের ক্লান্তি কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে বসল। বেশ ফুরফুরে লাগছে তার। তাড়াতাড়ি হেঁটে ঝোঁপঝাড়ের এপাশটা ঘুরে আওয়াজটার দিকে এগিয়ে দেখল, তিন-চারটে ছেঁড়া ফাড়া কাপড়ের তাঁবু টাঙ্গানো। কাছেই একটি কিশোরী কুরআন তিলাওয়াতে মগ্ন। কণ্ঠ যেমন মধুর, কিশোরী দেখতেও তেমনটি হৃদয়কাড়া। তাঁবু থেকে একটু দূরে দুই বুড়ো বসে রশি পাকাচ্ছে। তাবুর অন্য পাশে কজন মহিলা আর কয়েকটি ছোট শিশু। কজন শক্ত সামর্থ্য পুরুষও আছে।
কিরার আল হাকামকে আসতে দেখে সবাই তার দিকে দৃষ্টি ফেরাল। লম্বা লম্বা পা ফেলে আল হাকাম তাদের কাছে এসে দাঁড়াল।
“আপনাদের এ মেয়েটি একটি আয়াত ভুল পড়েছে”। বুড়োদের প্রতি ইঙ্গিত করে বলল আল হাকাম।
“আপনারা অনুমতি দিলে আমি তার ভুল শুধরে দিতে পারি।”
“ও কি ভুল শুদ্ধ পড়েছে আমরা শুনিনি। কাজে ব্যস্ত ছিলাম।” বলল এক বুড়ো।
“আপনাদের শোনা উচিত। কোত্থেকে এসেছেন আপনারা?” জিজ্ঞেস করল আল হাকাম
“আমরা তুকী। তুর্কী মুসলমান।” এক বুড়ো বলল।
তা তো আপনাদের দেখেই আমি বুঝতে পারছি আপনারা মুসলমান। ঠিক আছে আমি আগে ওর ভুলটা শুধরে দেই।
ধীর পায়ে এগিয়ে তেলায়াতকারী কিশোরীটির কাছে গিয়ে বসল আল হাকাম। অজ্ঞাত কেউ কাছে বসছে ঠাহর করে কিশোরী মুখ ফেরাল এবং কুরআন শরীফ পড়া বন্ধ করে দিল। অচেনা পুরুষকে কাছে বসতে দেখে সে জিজ্ঞাসুনেত্রে বুড়োদের দিকে তাকাল। তার চোখের চাওনিতে অপার জিজ্ঞাসা, কে এই পুরুষ এভাবে তার কাছে এসে আসন গ্রহণ করল?
আল হাকাম কোন ভণিতা না করেই বলল, “কুরআন শরীফ খোল। তুমি এক জায়গায় ভুল পড়ছিলে”। কিশোরী সে আয়াত থেকে আবার তিলাওয়াত করেও ভুল পড়ল।