পারেনি। ধ্বংসাবশেষ থেকে দুমড়ানো মুচড়ানো মূর্তির টুকরো আর জোড়া লাগেনি। মাটিতে মিশে যাওয়া দেবদেবীরা খাড়া হয়ে রুখতে পারেনি মূর্তিসংহারী মাহমূদকে। সুলতান মাহমুদের বিজয়ী সৈনিকেরা কাদা-মাটির মূর্তির উপর দিয়ে তাদের ঘোড়া হাকিয়ে দিলো। সোমনাথ থানেশ্বরের বিশালকায় মূর্তিগুলো মাহমূদ গযনবীর অশ্ববাহিনীর খুরাঘাতে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো, পদাতিক বাহিনীর পদতলে পৃষ্ঠ হয়ে মাটির সাথে মিশে গেলো। প্রতিরোধ করবে তো দূরে থাক আত্মরক্ষাও করতে ব্যর্থ হলো। সে সময়ের ব্রাহ্মণেরা দেবতাদের অক্ষমতা প্রত্যক্ষ করেছিল, স্বীকার করেছিল এক আল্লাহ্র বড়ত্ব, মেনে নিয়েছিল এক আল্লাহ্র গোলাম মাহমূদ গযনবীর বশ্যতা। অতঃপর পেরিয়ে গেল অনেক দিন।
এক সময় অতীত হয়ে গেলেন মাহমূদ গযনবী। ভারতের মন্দিরে মন্দিরে আবারো শুরু হলো শঙ্খধ্বনি, শুরু হলো গীত-ভজন। মন্দিরের শূন্য বেদীতে পুনঃস্থাপিত হলো আরো বিশাল বিরাটাকার পাথর-কংক্রীটের শক্ত মূর্তি। ব্রাহ্মণরা নতুন উদ্যোগে পুনরোদ্যমে শুরু করলো ভগঃভজনা। ১৯৯২ সালে বাবরী মসজিদ খুঁড়িয়ে দিয়ে হিন্দু-তপস্বীরা মূর্তিসংহারের প্রতিশোধ নিলো; জানিয়ে দিলো, সন্ন্যাসীরা মূর্তিনাশীদের প্রতিশোধ নিয়েছে, মুসলমানদের ইবাদতখানা মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে সেখানে মূর্তি স্থাপন করেছে। তারা মুসলমানদের শক্তি, বীরত্ব, কীর্তি গাঁথার ইতিহাসকে মুছে দিয়েছে।
বিগত হাজার বছরে মুসলমানরা ভারতের পৌত্তলিকদের কাছেই শুধু আত্মবিসর্জন দেয়নি, পৃথিবীর যে সব ভূখণ্ডে মুসলমানরা ছিল দণ্ডমুণ্ডের মালিক, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিধর্মীদের কাছে এসবের কর্তৃত্ব চলে গেছে। মুসলমানরা হারিয়েছে ঈমানী শক্তি, জাতীয়তা বোধ, বিস্মৃত হয়েছে নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্য, বিশ্বনবীর দেয়া শিক্ষা থেকে দূরে সরে পড়েছে। পরিণতিতে ভিমরুলের মতো চতুর্দিক থেকে হামলে পড়েছে বেঈমানেরা, সম্বিত হারানো ব্যাঘ্রের মতো মুসলিম নওজোয়ানরা দংশিত হয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, প্রতিরোধ করার ক্ষমতা রহিত হয়ে গেছে নিজেদের সৃষ্ট তুফানে। এখন মুসলমানদের অবস্থা টালমাটাল।
পুনরায় ভারতে ফিরে এসেছে পৌত্তলিকতার জৌলুস। গষনবী যেসব দেবালয় ধ্বংস করেছিলেন সেগুলো এখন আগের চেয়ে আরো বেশি জমজমাট। আধুনিকতার রঙিন ফানুসে উজ্জ্বলতার মূর্তিগুলো যেন পরিহাস করে বলছে, মুসলমানদের খোদা এখন আর নেই, এখন আর নেই মূর্তিসংহারী কোন মাহমূদ। ওরা সব মরে গেছে।
মিথ্যার ভূত ধ্বংসকারীদের চারিত্রিক রূপ কেমন হয়ে থাকে, আর ইসলামের শিকড় কীভাবে লোকচক্ষুর অন্তরালে কেটে দেয়া হয়, সেই সব জিজ্ঞাসার জবাব এবং অজানা অধ্যায়গুলোর চাপা পড়া ভয়ঙ্কর সব ঈমান কেনাবেচার উপাখ্যান জানতে হলে ফিরে তাকাতে হবে অতীতের দিকে, উন্মোচন করতে হবে ইতিহাসের ভাগাড় ঘেঁটে প্রকৃত সত্যকে, ঐতিহাসিকের দৃষ্টি যেখানে পৌঁছতে ব্যর্থ হয়েছে। সমকালীন শাসকদের তৈরি কঠিন প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে কোন পর্যবেক্ষকের সন্ধানী দৃষ্টিও নাগাল পায়নি প্রকৃত সত্যের, অন্ধকার থেকে উদ্ধার করা হয়েছে এই প্রকৃত সত্য ইতিহাস, চেপে রাখা ইতিহাস।
সত্য চাপা পড়ার কারণে মিথ্যার বিরুদ্ধে সংগ্রামী বীর সেনাদের কীর্তি বদলে গেছে, সত্যের পতাকাবাহীরা কথিত ইতিহাসে আখ্যা পেয়েছেন খলনায়ক আর খলনায়কদের দেয়া হয়েছে মহানায়কের আসন। সত্য-মিথ্যার আলো-আঁধারে মিশ্রিত ইতিহাসের জঞ্জাল যাচাই করে প্রকৃত সত্য উঘাটন করা যে কঠিন তা আন্দাজ করা যায় এ থেকেই যে, সুলতান মাহমূদ গযনবীকে সমকালীন প্রখ্যাত দুই মুসলিম ইতিহাসবিদও চিত্রিত করেছেন এভাবে :
“মাহমূদ গযনবী ছিলেন সোনা-দানা ও সম্পদ প্রাচুর্যের প্রত্যাশী। মন্দির ও মূর্তি ধ্বংসে তার বেশি আগ্রহের কারণ ছিল সেগুলোর ভেতরের মণি-মুক্তা, সোনা-দানা কজা করা”। অথচ অনেক হিন্দু ইতিহাসবিদও অকপটে বলেছেন যে, “মাহমূদ গযনবীর মণি-মুক্তা, সোনার প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। তিনি সোমনাথের মূর্তিগুলোকে আট আটটি টুকরো করে বাইরে ফেলে দিয়েছিলেন, তার সৈনিকেরা এগুলোকে পায়ে পিষে ফেলেছিলো, মূর্তির গায়ে কিংবা মন্দিরের কোথাও সোনা-দানা, মণি-মুক্তা গচ্ছিত রয়েছে কি-না অথবা মূর্তির গায়ে অলঙ্কার জড়ানো ছিল কি না এসবের প্রতি তাদের আদৌ ক্ষেপ ছিল না। মাটি ও পাথরের তৈরি এসব মূর্তির প্রতি মাহমূদ ও তার সৈনিকের ছিল প্রচণ্ড ঘৃণা। এগুলোর প্রতি আগ্রহভরে তাকানো, এসব থেকে সোনা-দানা খুলে নেয়ার কথা প্রকৃতপক্ষে মাহমুদের প্রতি আরোপিত চরম অপবাদ।”
মিথ্যা গুজবে ভর করে চলে। মিথ্যা ধ্বংসকারীদের সন্তানেরাই যখন গুজবকে সত্য বলে স্বীকার করে নেয়, পূর্বপুরুষদের প্রতি তাকায় সংশয় ও সন্দেহভরা দৃষ্টিতে, তখন সত্যের ভিত কেঁপে ওঠে, সত্যের শিকড় মূল থেকে ছিন্ন হতে থাকে, সত্যাশ্রয়ীরা আখ্যা পায় অত্যাচারীরূপে।
সেই ইতিহাসের অন্ধকারেই আমরা প্রবেশ করতে যাচ্ছি, যদিও সত্যের নাগাল পাওয়া কঠিন। তবে ইতিহাসের দিক-নির্দেশনা চিহ্নগুলোকে অবলম্বন করে সামনে অগ্রসর হলে অবশ্যই সত্যের নাগাল পাওয়া যাবে, বিচ্ছিন্ন টুকরো টুকরো সত্যের উপাদানগুলো একত্রিত করতে পুরো ঘটনা পূর্বাপর বেরিয়ে আসবে, খসে পড়বে মিথ্যার পলেস্তরা। তখন মাটিচাপা সত্য জীবন্ত হয়ে দেখা দেবে। একটু অনুসন্ধান করলেই বোঝা যায়, ইতিহাসকে মিথ্যার আবর্জনা দিয়ে চেপে রাখা যায় না, কীর্তিকে কলমের খোঁচায় মিটিয়ে দেয়া যায় না, জীবনত্যাগী শহীদ ও মজলুমদের আর্তনাদ ভুলে থাকা যায় না। কান পেতে শুনলে মাটি সত্য কথা বলে, সত্যাশ্রয়ীদের রক্তের উষ্ণতা অনুভব করা যায়, মজলুমের আহাজারি আজো ইথারে ভেসে বেড়ায়। এ সবকিছু অনুধাবন ও উদ্ধার করার জন্যে দরকার ঈমানদীপ্ত অনুভূতি, আল্লাহর দরবারে সিজদাবনত হৃদয়। ইথারে ভাসমান সেসব ঈমানদীপ্ত বীর সেনানীদের ঈমান জাগানিয়া তকবীর ধ্বনি, বেঈমানদের প্রতি তেজদীপ্ত-হুংকার ও তরবারীর ঝনঝনানি হৃদয়ঙ্গম করার জন্যে থাকতে হবে হৃদয় খাঁচায় হেরার নূরের জ্যোতি। হৃদয়ে ঈমানের দ্যুতিহীন আল্লাহর অভিশপ্ত সে সব মানব-পশুদের দলে থেকে মুমিন ও বেঈমানদের মধ্যে পার্থক্য পরখ করা অসম্ভব। যেহেতু আল্লাহ নিজেই ওইসব মিথ্যাবাদীদের আখ্যা দিয়েছেন পশুদের চেয়েও নিকৃষ্ট বলে। ঘোষণা করেছেন, “যারা সত্য বিমুখ ওদেরকানে সীসা ঢেলে দেয়া হয়েছে, ওদের অনুভূতিকে ভোতা করে দেয়া হয়েছে, ওরা দুনিয়াতেও ঘৃণিত অপমানিত আর আখেরাতেও ওদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি। মহান আল্লাহ্ ভালো জানেন, আখেরাতের শাস্তি কতো যন্ত্রণাদায়ক।”