“মা! এসব কাহিনী এর আগেও আপনি আমাকে শুনিয়েছেন কিন্তু আজ আপনি এত আবেগাপ্লুত কেন?”
“বাবা আমার চোখ থেকে আজ পানি ঝরছে এই আশঙ্কা করে যে, তোমার মন যেন বিলাস-ব্যসন, আরাম-আয়েশ, সুন্দর বাগান আর অট্টালিকার প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে পড়ে। তুমি শাহজাদা হলেও আমি চাই, তোমার আকর্ষণ থাকবে ময়দানে, যুদ্ধে, পাহাড়-মরুর কঠিন রণক্ষেত্রে। আমি তোমাকে এ কথাই স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, প্রাসাদ সরগরম ও সুসজ্জিত করার জন্যে তোমার জন্য নয়। তুমি দুনিয়াতে এসেছো ময়দানে লড়াই করতে। বাগানবাড়ি গড়ে তোলায় আপত্তি নেই। আমি তার সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। ভবিষ্যতে যুদ্ধ শেষে যখন ক্লান্ত হয়ে গজনী ফিরবে তখন এখানে তুমি আরাম করবে। আমার কাম্য এটাই।
মায়ের অনুমতি ও সহায়তায় বাগাবাড়ি তৈরি শুরু করে দিল মাহমুদ। বিভিন্ন এলাকা থেকে অট্টালিকা ও বাগান তৈরির অভিজ্ঞ লোকদের আনা হল। দ্রুতগতিতে শেষ করা হলো অবকাশ যাপন কেন্দ্রের কাজ। রাজা জয়পাল যখন গজনী আক্রমণ করতে এল তখন বাগান বাড়ির মনোরম দৃশ্য ও সুরম্য অট্টালিকার চারপাশে বাহারী রঙের ফুলের সমারোহ ও সবুজের মেলা তার চোখ ধাধিয়ে দিয়েছিল। পাঞ্জাবের রাজা জয়পাল গজনী আক্রমণ করে মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হল। সুবক্তগীনের বাহিনী আগাম খবর পেয়ে শহরের বাইরেই রাজার বাহিনীকে মোকাবেলায় বাধ্য করে। জয়পালের বাহিনী গজনী অবরোধের সময়টুকুও পায়নি। জয়পালের সাথে সুতান সুবক্তগীনের কঠিন লড়াই হল। কিন্তু জানবাজ সুবক্তগীনের সেনাবাহিনী মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে জয়পালের বিশাল সমর সজ্জাকে গুঁড়িয়ে দেয়। ডজন ডজন হাতি, হাজারো অশ্বারোহী-যোদ্ধা ও তোপ কামানের সহযোগিতা নিয়েও গজনীর সুবক্তগীনের রণকৌশলের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে পালাতে বাধ্য হয় জয়পাল। সুবক্তগীনের আশাতীত এ বিজয়ে এতো বিপুল পরিমাণ মালে গনীমত হস্তগত হয় যে, জয়পালের রেখে যাওয়া হাতি, অসংখ্য ঘোড়া ও মাল-আসবাব গোছাতে পনের দিনেরও বেশি সময়ের প্রয়োজন হয়। বিজয়ী সুবক্তগীন যুদ্ধ শেষে গজনী ফিরে এলে মাহমূদ তাকে জানাল তার অবকাশ কেন্দ্রের কাজ শেষ হয়েছে। মনোরম বাগান বাড়ি দেখে আপনি অবশ্যই মুগ্ধ হবেন। আলু, আপনি কি একবার বাগানবাড়িটি দেখতে যাবেন? আরজ করল মাহমুদ।
মাহমূদের মা সুবক্তগীনকে বাগানবাড়ি সম্পর্কে আগেই অবহিত করেছিলেন। পিতা ভেবেছিলেন, খেয়ালের বশে ছেলে হয়তো কিছু গাছগাছালি রোপণ করে ওখানে একটি ছোট্ট ঘর তৈরি করেছে। কিন্তু মাহমূদের আবেদনের প্রেক্ষিতে বাগান দেখতে গিয়ে তিনিও বিস্মিত হলেন। সুরম্য অট্টালিকা আর রাজসিক উদ্যানের কারুকার্য ও বিন্যাস মাহমূদের উন্নত কর্মকুশলতার স্বাক্ষর বহন করছিল। মুগ্ধ হলেন সুলতান সুবক্তগীন। ছেলের উদ্দেশে বললেন–
“মাহমূদ! তোমার এই উদ্যান, মহল ও আয়োজন মোবারক হোক। স্থাপত্যকলায় তোমার রুচি ও দক্ষতা প্রশংসার যোগ্য। তোমার এ কাজ এক শাহজাদার পরিচয় বহন করছে, কিন্তু মনে রেখো, তুমি শুধু একজন শাহজাদা নও। তোমাকে আমি ইসলামের তরে নিবেদিতপ্রাণ সৈনিক হিসেবে দেখতে চাই। তুমি মামুলী কোন রাজকুমারও নও, এক মুসলিম যোদ্ধার ঔরসজাত সন্তান। তুমি ভুলে যেয়ো না, প্রকৃতপক্ষে তুমি নগণ্য এক গোলামের ছেলে। আল্লাহ তা’আলা মেহেরবানী করে তোমার বাবাকে গজনীর সালতানাতের আসনে অভিষিক্ত করেছেন। সেই সাথে জন্মসূত্রে এক মহান দায়িত্ব আমাকে বহন করতে হচ্ছে, যা আমার বাবার সাথে বিয়ে হওয়ার অনেক আগে থেকেই আমার মা বহন করছিলেন। এ গুরুদায়িত্ব জাগতিক সবকিছুর চেয়ে আমার কাছে বেশি প্রিয় বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
আমি আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ যে, আল্লাহ তাআলা এই মহান কর্তব্য পালনের দায়িত্ব আমার ও আমার উত্তরসূরিদের কাঁধে ন্যস্ত করেছেন। তোমার মা ও আমার মুখে বহুবার তুমি শুনেছে যে, তোমার জন্ম অন্য সাধারণ শাহজাদাদের মতো আদৌ মামুলী নয়। তোমার জন্মের ইঙ্গিত তোমার দাদু ও তোমার দাদী বহু পূর্বে আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। তিন পুরুষ ধরে আমার বাপ-দাদা তোমার আগমন আকাঙ্ক্ষায় ধীর অপেক্ষায় সময় কাটিয়েছেন। আমাদের বিশ্বাস ও আশা, তুমি মূর্তিসংহারীরূপে ইসলামের ঝাণ্ডাবাহী শাসক হিসেবে বিশ্বজোড়া খ্যাতি বয়ে আনবে।”
আব্বু! আপনি বলছেন যে, এই সুরম্য অট্টালিকা আর হৃদয়কাড়া বাগানবাড়ি তৈরি করা আমার উচিত হয়নি! একটু ম্লান মুখে বলল মাহমুদ।
না মাহমূদ! এই বাগানবাড়ি তৈরি করা তোমার উচিত, কি উচিত নয়, সে ভিন্ন কথা। আমি তোমাকে বোঝাতে চাচ্ছি, যে কোন সম্পদশালী লোকের পক্ষেই এমন প্রাসাদ ও উদ্যান তৈরি খুব সহজ, কিন্তু তোমার কাঁধে যে গুরু দায়িত্ব অর্পিত রয়েছে তা যে কারো পক্ষে পালন করা সম্ভব নয়। রাজা-বাদশা ও শাহজাদারা উঁচু প্রাসাদ, মহল, অট্টালিকা ও স্মৃতিস্মারক এ জন্যই তো তৈরি করে যে, মানুষ তাদের দীর্ঘদিন মনে রাখবে। কিন্তু মনে রেখো, ইট-পাথরের এসব দালান-কোঠা চিরস্থায়ী নয়। মাটির উপরে নয়, মানুষের হৃদয়ে এমন স্মৃতি সৌধ নির্মাণ কর যার জন্য মানুষ তোমাকে অনাদিকাল স্মরণ করবে। ইতিহাসের পাতায় তোমার কীর্তি চিরদিন জীবন্ত হয়ে বিরাজ করবে। চার দেয়ালে ও ইটপাথরের দালানে নিজের জীবনকে আবদ্ধ করো না। নিজের মেধা ও কর্ম দিয়ে ইতিহাসের পাতা দখল কর। নিজের নাম এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত কর যা কোনদিন ম্লান হবে না, রঙ হারাবে না, নষ্ট হবে না। মানুষ তোমাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে চিরকাল।