এক রাতে স্বপ্নে দেখলেন সুবক্তগীন, তার ঘরের ছাদ ভেদ করে একটি গাছ বেড়ে উঠছে। বাড়তে বাড়তে গাছটি এমন বিশাল ও বিস্তৃত হলো অর্ধেক পৃথিবী সেই গাছের ছায়া ঢেকে নিলো।
স্বপ্ন দেখে খুব বিচলিত হলেন সুবক্তগীন। স্ত্রীকে বললেন স্বপ্নের কথা। স্ত্রী নীরবে শুনলেন, কোন মন্তব্য করলেন না। এ দিনই তার ঘরে জন্ম নিল প্রথম সন্তান; স্বপ্নের সুবিস্তৃত মহীরুহ। পুত্রের আগমনে তার উৎকণ্ঠা দূর হয়ে গেল। এবার স্ত্রী তাকে বললেন, আপনার দেখা স্বপ্ন আপনার চোখের সামনে বাস্তব হয়ে দেখা দিয়েছে। আমি সেই পুত্রটি প্রসব করেছি যে পৃথিবী থেকে মিথ্যা দূর করবে। আজ মুহররম মাসের দশ তারিখ। আল্লাহর ইঙ্গিত অনুধাবন করে আমাদের তাঁর দরবারে অবনত মস্তকে বিগলিত হৃদয়ে শুকরিয়া জ্ঞাপন করা উচিত।
সুবক্তগীন ছেলের নাম রাখলেন মাহমুদ। দেখতে তার ছেলে খুব একটা হৃদয়গ্রাহী চেহারার অধিকারী না হলেও পিতার সব চিন্তা ও আকাঙ্ক্ষা-আগ্রহের কেন্দ্র ছিল এই সন্তান।
অতি শৈশবে-ই পিতা ছেলেকে কুরআন শরীফ হিফয করালেন। বার বছরের মধ্যে জরুরী কিতাবাদির ইলম শেখার পর্ব শেষ করিয়ে ফেললেন। পনের বছরে পদার্পণ করলে সুবক্তগীন ছেলেকে হিন্দু রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাঠিয়ে বললেন, “তোমাকে মূর্তিসংহারী হতে হবে।”
গজনীর শহরতলী থেকে একটু দূরে মাঠের মধ্যে একটি মনোরম বাগান। বাগানের মাঝখানে এক দৃষ্টিনন্দিত বালাখানা। বাগানের মনোহারী গাছগাছালি, রঙ বেরঙের হাজারো ফল-ফুলের সমারোহ আর এর পরিপাটি সাজানো গোছানো পরিবেশ বহুদূর থেকেই মানুষের নজর কাড়ে। প্রথমেই তারা ভাবত আলীশান এ কাজ কোন সাধারণ জমিদারের নয়। অবশ্য কোন শাহজাদা কিংবা উজির গড়ে তুলেছে এ বাগান ও সুরম্য সৌধ। অথচ কিছুদিন আগেও জায়গাটা ছিল ধূ ধূ প্রান্তর, ছিল গাছপালা শূন্য। গজনীর মানুষ দল বেঁধে এই বাগান ও বালাখানা দেখতে যেতো, পথিকরা এর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতো, পথিক এখানে এসে থমকে দাঁড়াতো। দর্শকদের মুখে সুবক্তগীনের পুত্র মাহমূদের প্রশংসা ও গুণকীর্তন শুনে জনতা তার প্রতি আরো সশ্রদ্ধ হতো।
এই বাগান বাড়ি, অবকাশ কেন্দ্র মাহমূদ তার বাবা সুবক্তগীনের অজ্ঞাতে তার মায়ের অনুমতি নিয়ে গড়ে তুলেছিল। মাহমূদ ছিল তার মা-বাবার কদাকার ও বেঢপ চেহারার কাঙ্ক্ষিত পুত্র। মাহমূদের তুলনায় তার ছোট ভাই দৈহিকভাবে ছিল দারুণ আকর্ষণীয়। কয়েক বছর আগে মাহমূদ যখন মাকে বলেছিল, সে একটি মনোরম বাগানবাড়ি বানাচ্ছে, একথা শুনে মা তার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে কেঁদে ফেলেছিলেন।
মায়ের চোখে পানি দেখে মাহমূদ বলল, মা আমি যদি একথা বলে আপনাকে কষ্ট দিয়ে থাকি তাহলে আমাকে মাফ করে দিন। আমি আর বাগানবাড়ি বানাচ্ছি না।
না বেটা! বাগানবাড়ি তোমাকে আমিই বানিয়ে দেব। তাহলে আপনার চোখে পানি কেন?
বেটা! আমার মনে পড়ছে সেই স্মৃতি। তোমার বাবার সাথে তখন আমার বিয়ে হয়নি। আমি ছিলাম এক বড় কর্মকর্তার বাগদত্তা। কিন্তু তোমার বাবার প্রতি আমার মনে প্রচণ্ড টান অনুভব করছিলাম। আমি তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। আমি বাগদত্তাকে এজন্য পছন্দ করতে পারছিলাম না, সে আমাকে হেরেমের চার দেয়ালে বন্দী রাখতে চেয়েছিল। সে হেরেমের সৌন্দর্য বর্ধনের সামগ্রী মনে করতো নারীকে। আমার ঘুরে বেড়ান, ঘোড়ায় সওয়ার হওয়া ও সাঁতার কাটায়ও তার ছিলো চরম আপত্তি। আমি নিজেকে হেরেমের শোভা করে। রাখতে মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। আমি তোমার আব্বাকে বলেছিলাম, আমি এমন স্বামী চাই, যে আমার সাথে ঘোড়া দৌড়াবে, নদীতে সাঁতার কাটবে।
আমি তোমার আব্দুকে বলেছিলাম, হেরেমের রক্ষিতা-নারীদের গর্ভজাত সন্তান কখনো ইসলামের প্রহরী হয় না। আমি এমন ছেলের মা হতে চাই, যে সুদূর ভারত পর্যন্ত ইসলামের পয়গাম প্রচার ও ইসলামী সালতানাত সম্প্রসারিত করবে। মুবাল্লিগের বেশে নয় বিজয়ী সুলতান বাহাদুর হিসেবে, শুধু কূটনীতির বলে নয় তরবারীর জোরে। তোমার আব্লু হেসে বলেছিলেন, “তোমার মতো আমার আম্মুও এ কথাই বলতেন, কিন্তু আমি তো দাস-দাসীর হাটে বিক্রি হওয়া এক গোলাম।” তোমার আব্বকে আমি বলেছিলাম, “ইসলামের অতন্দ্র প্রহরী তোমার মতো কর্তব্যনিষ্ঠ গোলামরাই হতে পারে। দৌলতওয়ালা আমীর-উমারা শ্ৰেণী ইসলামের রক্ষক হবে তো দূরে থাক ইসলামকে তারা ডুবাচ্ছে। দেখ না, আমার আব্বাও তোমার মত হাটে গোলাম হিসেবে বিক্রি হয়েছিলেন, কিন্তু তিনি নিজের কর্মনিষ্ঠা ও চেষ্টায় আজ বুখারার শাসক পদটি অলঙ্কৃত করে আছেন। আরো একটি কথা আমি তোমার আন্ধুকে বলেছিলাম। বলেছিলাম, আমি যে মহানায়কের কথা ভাবি, সেই সন্তান তোমার ঔরসে আমার গর্ভে সঞ্চারিত হোক, তা আমি একান্তভাবে কামনা করি। আমি সেই কাঙ্ক্ষিত সন্তানের গর্বিত মা হতে চাচ্ছি। তোমার আব্দুর প্রতি আমার এই আকর্ষণ ও ভালবাসায় বিন্দুমাত্র যৌবনের তাড়না আর কৈশোরের উন্মাদনা ছিল না। ছিল নির্ভেজাল পবিত্র আকাক্ষার হৃদয়তন্ত্রী ছেঁড়া যন্ত্রণার জীবন্ত ছবি আঁকার এক বিনীত নিবেদন। আমার মনের গহীনে আশৈশব লালিত স্বপ্নের বাস্তবচিত্র দেখতে মনটা বেকারার ছিল। আল্লাহর ইচ্ছায় ও তোমার আব্বার দূরদর্শিতায় আমার সাথে তার বিয়ের সব বাধা অল্পতে দূর হয়ে যায়। দাসের হাটে বিক্রিত গোলাম সুবক্তগীন একদিন গজনীর সুলতান হিসেবে আমার আব্বার স্থলাভিষিক্ত হলেন। তোমার আব্বকে আল্লাহ তাআলা বিস্ময়কর এক স্বপ্ন দেখালেন। এর পরদিনই তুমি জন্মগ্রহণ করলে। আমি তাকে বললাম, আপনার গতকালের স্বপ্নের ব্যাখ্যা আজ মূর্তি না হয়ে আমার কোলে ঘুমিয়ে আছে। সেদিন ছিল আশুরা। দশই মুহররম। তোমার আব্দুকে আমি বললাম, আজ দশই মহররম, ইতিহাসের বহু শ্রেষ্ঠ ঘটনা আজ ঘটেছে। আমার এই ছেলের জীবন-কাহিনীও ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। আপনি বিশ্বাস করুন, আমি সেই বাহাদুর কাঙ্ক্ষিত ছেলের জন্ম দিয়েছি, যে পৃথিবীতে ইসলামের ঝাণ্ডা বুলন্দ করবে, বাতিল ধ্বংস করবে, মূর্তিসংহারী হবে।”