সবাই দৌড়ে গেল অকুস্থলে। রথের চাকা ও ঘোড়ার খুরের আঘাতে নিহত হল আবু ইসহাক। দেখা গেল, আবু ইসহাকের ঘোড়া গভীর গর্তে ধসে গেছে। উপরে বড় বড় গাছের পাটাতন। অথচ গতকাল পর্যন্ত কেউ কোন গর্ত এখানে দেখেনি। হঠাৎ গর্ত হওয়ার কোন কারণ নেই। দুর্ঘটনার তদন্ত তখনই শুরু হয়ে গেল। কিভাবে এখানে গভীর গর্ত হল, কি আছে এই দুর্ঘটনার অন্তরালে?
আলপ্তগীন জলদগম্ভীর কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, এই গর্ত ও দুর্ঘটনার কারণ অবশ্যই খুঁজে বের করা হবে। কেউ যদি এই গর্তের উৎস সম্পর্কে সঠিক তথ্য প্রদান করে, তবে তাকে রাজকীয় পুরস্কারে ভূষিত করা হবে।
পরদিন বেলা ডোবার আগেই রহস্য বেরিয়ে পড়ল। জানা গেলো, এই রাতের মহড়ার আয়োজক যেমন আবু ইসহাক, গর্তের নায়কও সে। আবু ইসহাক তার এক বিশ্বস্ত লোকের মাধ্যমে সুবক্তগীনকে মহড়ায় অংশ গ্রহণে সম্মত করিয়েছিল, আর অতি সংগোপনে রাতের আঁধারে বিশাল গর্ত খুঁড়ে মাঠে মাটি ছড়িয়ে গর্তের উপরিভাগে গাছের পাটাতন দিয়ে তাজা ঘাস ও মাটি দিয়ে তা ঢেকে দেয়া হয়েছিল। যাতে কেউ গর্তের অস্তিত্ব ঠাহর করতে না পারে। জায়গাটি নিজে চেনার জন্যে একটি আলামত রেখেছিল আবু ইসহাক। এজন্যই দৌড় শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরই সে সুবক্তগীনের রথকে ঠেলে গর্তে ফেলার চেষ্টা করছিল, কিন্তু বিচক্ষণ সুবক্তগীন আবু ইসহাকের চক্রান্তের আশঙ্কা আঁচ করে আগাগোড়া দৌড়ের মধ্যে থেকেও নিজেকে সচেতন রেখেছিল সম্ভাব্য দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্যে। দুর্ভাগ্যবশত নিজের খনন করা গর্তে আবু ইসহাক নিজেই কুপোকাত হল। আবু ইসহাক তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের বলেছিল, মহড়ার মোড়কে সুবক্তগীনকে হত্যা করে সে আলপ্তগীনের কন্যাকে বিয়ে করবে। পথের কাঁটা সরিয়ে দেয়ার জন্যেই আবু ইসহাক আয়োজন করেছিল ষড়যন্ত্রের এই সামরিক মহড়া। কিন্তু নিজের পাতা ফাঁদে নিজেই ফেঁসে গেল।
“আল্লাহ তোমার দ্বারা বড় কোন কাজ নেবেন, এজন্যই নিশ্চিত মৃত্যু থেকে বাঁচিয়ে রেখেছেন তোমাকে।” বললেন আলপ্তগীন। আমি তোমাকে ওয়াদা দিচ্ছি যে, আমার আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্যে তুমি যে পরিকল্পনা পেশ করেছিলে সে অনুযায়ী এখনি কাজ শুরু করতে হবে। তুমিই আমার মেয়ের জামাতা হবে, এজন্যে আমি গর্বিত।”
এ ঘটনার প্রায় এক বছর পর গজনীর শাসক আব্দুল মালেক মৃত্যুবরণ করলেন। আলপ্তগীন প্রাণান্ত চেষ্টা করেও আব্দুল মালেকের কনিষ্ঠ পুত্রকে গদীনশীন করাতে ব্যর্থ হলেন। বড় ভাই মনসুরের বর্তমানে বাস্তবায়িত হলো না তার এই স্বপ্ন। দুদিন পর সুবক্তগীন তিনশ’ নির্বাচিত অশ্বারোহী সৈনিক নিয়ে গজনী উপস্থিত হল। সে দৃশ্যত ভাব দেখাল যে, তারা বুখারার গভর্ণরের পক্ষ থেকে নতুন গদীনশীনকে মোবারকবাদ জানাতে এসেছে। কিন্তু রাজপ্রাসাদে ঢুকেই তারা মনসুরকে গ্রেফতার করল। আর তার সাথীরা পূর্ব নির্দেশনা মতো প্রতিরক্ষা বাহিনীর চৌকিগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে গজনী বাহিনীকে নিরস্ত্র করে ফেলল। পরিকল্পনার দ্বিতীয় পর্যায়ে দ্রুত বেগে আলপ্তগীন শহরের প্রধান প্রধান স্থাপনাগুলো দখল করে নিলেন। তিনি অগ্রভাবে সুবক্তগীনকে পাঠিয়ে বেশি সংখ্যক সৈন্য নিয়ে শহরের বাইরে অপেক্ষমান ছিলেন, যাতে প্রথম অপারেশনের পর দ্বিতীয় পর্যায় দ্রুততার সাথে সমাধা করা যায়। হাটে-বাজারে, অলি-গলিতে প্রচার করা হলো, “জালেমদের শাসন শেষ, এখন থেকে ন্যায় ও ইনসাফভিত্তিক শাসন চলবে। আমরা আল্লাহর জমিনে আল্লাহর বিধানমতো শাসন কাজ চালাব”। প্রথম দিন থেকেই ইসলামী অনুশাসন চালু করা হল। দিন যত যেতে লাগল, মানুষ দেখতে পেল, সত্যিকার অর্থেই জুলুম ও নিপীড়নের পরিবর্তে আদল ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। মানুষের মন থেকে জুলুম-অত্যাচারের আতঙ্ক দূর হয়ে গেছে। শাসকদের প্রতি মানুষের মনে ঘৃণার বদলে শ্রদ্ধা জন্মাতে শুরু করেছে। গজনীর অধিবাসীরা নতুন শাসকদের মোবারকবাদ জানাল হৃদয়ের সবটুকু শ্রদ্ধা উজাড় করে।
ঐতিহাসিকদের মতে ৯৬২ ইংরেজী মোতাবেক ৬৫১ হিজরী সনে আলগীন গজনীর শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তিনি সুবক্তগীনকে প্রধান উজীর নিযুক্ত করেছিলেন। কিন্তু অল্পদিন পর তার জীবন প্রদীপ নিভে গেল। পরের বছরই তিনি ইন্তেকাল করেন। তার মৃত্যুর পর ছেলে ইসহাক পিতার স্থলাভিষিক্ত হয়। কিন্তু পিতার মতো ন্যায় ও ইনসাফের পরিবর্তে সে মোসাহেব ও তোষামোদকারীদের বেশি গুরুত্ব দিতে শুরু করে। স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী তাকে দিয়ে সুবিধাজনক সব নির্দেশ জারী করিয়ে নিতে থাকলে দেশে আবার অশান্তি দেখা দেয়। জনগণ আবার নতুন হয়রানির কবলে পড়ে।
সুবক্তগীনকে আবার দুঃসাহসী ভূমিকা নিতে হয়। তিনি বাধ্য হয়ে নীতি ও আদর্শচ্যুত শাসক ইসহাককে বন্দী করে কয়েদখানায় নিক্ষেপ করেন। দেশের মানুষ যখন শুনল, বিপথগামী ইসহাককে বন্দী করে আমীরুল উমারা সুবক্তগীন ক্ষমতাসীন হয়েছেন তখন তারা স্বস্তিবোধ করে এবং শান্তির আশায় আশ্বস্ত হয়।
ইসহাককে ক্ষমতাচ্যুত করাটা সুবক্তগীনের জন্যে ছিল কঠিন বিষয়। এই সুকঠিন ও অসম্ভব কাজটিকেই তিনি সম্ভব করতে পেরেছিলেন মানুষের ভালোবাসা ও আস্থার জোরে।
তার উন্নত চরিত্র, ন্যায় নিষ্ঠা ও সদাচারে সেনাবাহিনীর সিপাই থেকে সালার পর্যন্ত সবাই ছিল তার প্রতি সশ্রদ্ধ ও অনুগত। ন্যায় বিচার ও সতোর আস্থা সাধারণ নাগরিকের হৃদয়ের মণিকোঠায় নিজের স্থান করে নিয়েছিলেন সুবক্তগীন। নাগরিকরা তার শাসনে নিশ্চিন্তে জীবন যাপন করার অধিকার পেয়েছিল। যার ফলে তার প্রতিটি হুকুম ও নির্দেশ বাস্তবায়নে সাধারণ মানুষ নিজেদের উৎসর্গ করে দিয়েছিল। অল্পদিনের মধ্যে আশপাশের রাজ্যগুলোকে নিজের কজায় নিতে সক্ষম হয়েছিলেন সুবক্তগীন। গঠন করতে পেরেছিলেন এক জীবনবাজী সেনাবাহিনী। গজনীর অবস্থা কিছুটা স্থিতিতে এনেই তিনি মনোযোগী হয়েছিলেন হিন্দু শাসিত অত্যাচরিত ভারতীয়দের প্রতি।