আপনার সেনাবাহিনী বিশেষ করে যারা বুখারায় আছেন তারা আপনার সহযোগিতা করবে? জানতে চাইলো সুবক্তগীন।
এখানকার সেনাপতি কেন্দ্রের চেয়ে বেশি আমার অনুগত। কেন্দ্রের প্রতি সে খুবই ক্ষুব্ধ। আমার নির্দেশ পালনে সে গর্ববোধ করে, আমার নীতি-আদর্শের প্রতি সেনাপতি খুবই শ্রদ্ধাশীল। আমি আশা করি, গজনীকে কেন্দ্র করে স্বাধীনতা ঘোষণা করে এ অঞ্চলের ছোট ছোট রাজ্যগুলো একত্রিত করে কাফেরদের বিরুদ্ধে জিহাদে লিপ্ত হবো। আমরা যদি এটা করে যেতে না পারি তাহলে আমার ভয় হয়, টুকরো টুকরো মুসলিম রাজ্যগুলো কাফেরদের চক্রান্তে চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাবে। ওদের বিজয় স্রোতে মদ, নারী আর বিলাসিতায় আচ্ছন্ন মুসলিম আমীররা খড়কুটোর ন্যায় ভেসে যাবে। এই জমিন থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে মুসলিম শাসনের নাম নিশানা। আমি শুনতে পেলাম, হিন্দুস্তানের মহারাজা খায়বার গিরিপথ দিয়ে আমাদের উপর আক্রমণ করার পাঁয়তারা করছে।
গজনীর তখত উল্টে ফেলার কাজটা আমাকে সোপর্দ করতে পারেন। এজন্য তেমন কোন সৈন্য সমাবেশের দরকার হবে না। মনসুর ও মনসুর-এর সহযোগী শাসকদের গ্রেফতার করাও তেমন কঠিন কাজ নয়। কিন্তু আপনার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রাসঙ্গিক ও আনুষঙ্গিক দিকগুলো আরো গভীরভাবে ভেবে দেখা দরকার। সম্ভাবনা ও আশংকাগুলো চিহ্নিত করে সামনে এগুতে হবে আমাদের। বললো সুবক্তগীন।
কিছুক্ষণ নীরব থেকে সুবক্তগীন আরো বলল, “এখনও উপযুক্ত সময় হয়নি। এ ধরনের পরিকল্পনার সফলতা অনেকখানি নির্ভর করে গোপনীয়তার উপর। আপনার মেয়ের মুখে আপনার পরিকল্পনার কথা আমি শুনেছি। অথচ এ সব ব্যাপার তাদের জানার কথা নয়। আপনাকে আরো গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে এবং সতর্ক হতে হবে। আপনার পরিকল্পনা যদি প্রকাশ না পায়, আর অন্যদের তৎপরতার আগাম খবর যদি আপনি সংগ্রহ করতে পারেন, তাহলে যুদ্ধের অর্ধেক বিজয় এমনিতেই হয়ে যায়।”
আলপ্তগীনের দৃঢ় আস্থা ও বিশ্বাস ছিল যে, সুবক্তগীন যোগ্য সালার ও বুদ্ধিদীপ্ত যুবক। কিন্তু সে এতোটা দূরদর্শী তা আগে অনুধাবন করতে পারেননি। যুদ্ধ পরিকল্পনায় তার ভুলগুলো সুবক্তগীন এমন সরল ও সুনিপুণভাবে বুঝিয়ে দিল, যার ফলে আলপ্তগীন আস্থার সাথে যুদ্ধকৌশল নির্ধারণের কাজ তার উপর ন্যস্ত করলেন। কিন্তু সুবক্তগীন তার অদক্ষতা ও অনভিজ্ঞতার কথা সামনে তুলে ধরে বলল, পরিকল্পনা আপনি করুন, আমি নিজেকে এ কাজে উৎসর্গ করে দিতে প্রস্তুত আছি।
দীর্ঘ পর্যালোচনার পর নতুন একটি রণকৌশল চূড়ান্ত করা হলো। এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ গোপনীয়তা বজায় রাখার ব্যাপারটি আবারো আলপ্তগীনকে স্মরণ করিয়ে দিল সুবক্তগীন।
ওদিকে যখন গজনীকে ইসলামী সালতানাতের কেন্দ্র বানানোর পরিকল্পনা চূড়ান্ত হলো, এদিকে তখন সুবক্তগীনকে হত্যার পরিকল্পনাও পাকা হয়ে গেছে। এ পরিকল্পনার নায়ক আলপ্তগীনের কন্যার বাগদত্তা আবু ইসহাক। এরা রাতে একটি সামরিক মহড়ার পরিকল্পনা করল। অশ্বারোহী বাহিনীর একটি সামরিক মহড়ায় সুবক্তগীনকে দাওয়াত দেয়া হল। আবু ইসহাক নিজেও সেই মহড়ায় অংশ গ্রহণ করবে।
অনেকগুলো রথ-গাড়ীতে ঘোড়া জুড়ে দেয়া হল। আবু ইসহাক ও সুবক্তগীনের জন্য বরাদ্দ করা হলো প্রথম সারির বিশটি রথের দু’টি। মহড়া শুরু হল। বাতাসের বেগে তাজী ঘোড়া রথ নিয়ে দৌড়াতে লাগল। কিছুক্ষণ পর আবু ইসহাক সুবক্তগীনের রথকে এক পাশে ঠেলে দিয়ে তার রথ এগিয়ে নিল। সুবক্তগীন লক্ষ্য করল, আবু ইসহাক উদ্দেশ্যমূলকভাবে তাকে একদিকে চেপে রাখতে চাচ্ছে, আর বারবার সে সামনের দিকে তাকিয়ে কি যেন পরখ করছে। রথের ঘোড়া দৌড়াচ্ছে উধশ্বাসে। ব্যাপারটি উদ্দেশ্যমূলক হতে পারে ভেবে সুবক্তগীন তার ঘোড়া আগ বাড়িয়ে আবু ইসহাকের রথকে ঠেলে সোজা চলতে তৎপর হলো। সাধারণ দর্শকরা একে দুই বড় কর্মকর্তার লড়াই ভেবে চিৎকার করে ময়দান মুখরিত করে তুলল। সারা ময়দান জুড়ে বিশেষ মহড়া দেখার জন্যে অসংখ্য লোক সমাগম হল। সকলের মুখে উল্লাস ও হর্ষধ্বনি। সারা ময়দান অসংখ্য মশালে উদ্ভাসিত, উৎসব মুখর।
সুবক্তগীন অবস্থাদৃষ্টে বুঝে ফেলল, আবু ইসহাকের দৃষ্টি মহড়ায় বিজয়ী। হওয়ার চেয়ে তাকে এক পাশে রাখার প্রতি নিবদ্ধ। সুবক্তগীন তার রথ নিয়ে আবু ইসহাকের রথের আগে আগে দৌড়াতে লাগল। আবু ইসহাকের গতিপথ ঠেলে সোজা চালাতে বাধ্য করছিল। এক পর্যায়ে আবু ইসহাক ঘোড়াতে আঘাত করার হান্টার দিয়ে সুবক্তগীনের মাথা লক্ষ্য করে আঘাত করল, কিন্তু সুবক্তগীনের রথ তখন আবু ইসহাকের রথ ঠেলে আগে চলে গেছে। হান্টার লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। আবু ইসহাক চিৎকার দিয়ে বলল, খোদার কসম! তুমি এদিক থেকে সরে যাও! সুবক্তগীন তার ঘোড়াকে দূতগতিতে অপরদিকে ঘুরিয়ে নিল। ইত্যবসরে আবু ইসহাকের ঘোড়া জমিনে ধসে গেল। রথ ছিঁড়ে উপরে উঠে উল্টে জমিনে আছড়ে পড়ে অগ্রভাগ ধসে গেছে। আবু ইসহাক তাল সামলাতে না পেরে শূন্যে উঠে গিয়ে উল্টে যাওয়া রথের নীচে চাপা পড়ল। দ্রুত পিছনে ছুটে আসা রথগুলোকে চালকেরা সামলাতে পারল না। সেগুলো আবু ইসহাকের উল্টে যাওয়া রথকে মাড়িয়ে চলে গেল। আবু ইসহাক রথের চাপে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছিল। সে আর দাঁড়াতে পারল না। ঘোড়ার পায়ে পিষ্ট হল। সুবক্তগীন নিজের রথকে ঘুরিয়ে যাত্ৰাস্থলে ফিরে এলো। উৎসব মুহূর্তের মধ্যে থেমে গেল, নেমে এলো বিষাদের ছায়া। হাহাকার বয়ে গেল সবার মুখে। কী হলো? কী হলো?