অ্যাঁ! এত স্পর্ধা! ছোট মুখে বড় কথা শুনে রাখ, আর কোনদিন অনুমতি ছাড়া আস্তাবল থেকে ঘোড়া নিতে পারবে না! ক্ষুব্ধকণ্ঠে বলল তরুণীর বাদগত্তা।
তুমি তো নসরের গোলাম- বলল সুবক্তগীন।
তোর দেহ থেকে মাথা কেটে ফেলব! কোমরে বাঁধা তরবারী কোষমুক্ত করে বাঘের মতো গর্জে উঠল ভাটাপড়া যৌবনের অধিকারী পৌঢ়-প্রায় লোকটি।
সুবক্তগীনের কোমরেও খঞ্জর ছিল। সে ঘোড়ার লাগাম ছেড়ে দিয়ে কোমর থেকে খঞ্জর বের করে বলল, দেড়হাত লম্বা তরবারী যদি আধহাত খঞ্জর দিয়ে আমার পায়ের নীচে না ফেলতে পারি, তবে তোমার তরবারীর নীচে মাথা পেতে দেবো। আমার মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে দিও আপত্তি নেই, কিন্তু এর আগে তোমার বাগদত্তা শাহজাদীকে জিজ্ঞেস করে এসো যে, সে তোমাকে ভালোবাসে, না ঘৃণা করে!
লোকটি সুবক্তগীনের সাহস ও আত্মবল পরখ করল। কিছুক্ষণ দূর থেকে অগ্নিদৃষ্টি বর্ষণ করে রাগে গড় গড় করে তরবারী কোষবদ্ধ করে স্থান ত্যাগ করল। সুবক্তগীন পুনরায় খঞ্জর কোমরে খুঁজে ঘোড়ায় চড়ে আস্তাবলের দিকে চলে গেল।
তখন সন্ধ্যার আঁধার চতুর্দিকে ছেয়ে গেছে। আস্তাবলে ঘোড়া রেখে মাত্র নিজের থাকার ঘরে প্রবেশ করেছে সুবক্তগীন। তখনই এক লোক খবর দিল, গভর্ণর আপনাকে তলব করেছেন। ভেজা কাপড়েই গভর্ণর হাউজের দিকে রওয়ানা হল সুবক্তগীন।
আবু ইসহাকের সাথে কি নিয়ে ঝগড়া করলে? জিজ্ঞেস করলেন গভর্ণর আলগীন।
সুবক্তগীন তাকে ঘটনা বিস্তারিত বলল। একথাও বললো, যা তার মেয়ে তার উদ্দেশ্যে বলেছে। সুবক্তগীনের অকপট ও অকৃত্রিম বক্তব্য ভাল লাগল গভর্ণরের কাছে।
আমার একটা অনুরোধ জাঁহাপনা। আপনার আদুরে মেয়েকে আমার মতো হতচ্ছাড়ার হাতে তুলে না দেওয়াই ভাল। কিন্তু আমি আপনাকে করজোড়ে নিবেদন করছি, ওই লোকের হাতে ওকে সোপর্দ করা মোটেই ঠিক হবে না। গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন গভর্ণর। অনেকক্ষণ নীরব থেকে বললেন, এখন তুমি গিয়ে আরাম কর সুবক্তগীন। পরে তোমাকে ডাকব।
জাঁহাপনা! আপনি অসন্তুষ্ট হলেও আপনার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করার মত কোন অপরাধ আমি করিনি। মিথ্যা কথা আমি কখনো বলি না।
আলপ্তগীন মুচকি হেসে তাকে চলে যাওয়ার জন্যে ইশারা করলেন। সুবক্তগীন গভর্ণর হাউজ থেকে নিজের থাকার ঘরে চলে এল।
পরদিন আলপ্তগীনের কন্যা প্রতিদিনের মতো ঘোড়া নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। সুবক্তগীনও আস্তাবল থেকে একটা ঘোড়া নিয়ে নদীর তীরের দিকে চলল। প্রথম দিকে দুজন দুদিকেই ঘোড়া দৌড়াল। অনেক দূর গিয়ে উভয়ে নদীর তীরের দিকে গতি ঘুরিয়ে দিল। নদীর তীরে গিয়ে বিপরীত দিক থেকে এসে উভয়ে মুখোমুখি হল এবং ঘোড়া থেকে নেমে নদীর তীরের সবুজ ঘাসের উপর গিয়ে বসল।
ওই গবেটটা আমার কাছে গিয়েছিল। বাগদত্তা সম্পর্কে বলল তরুণী। খুব রেগে ছিল। আমাকে বলল, আমি সেনাবাহিনীর কমান্ডার। তুমি একটি গোলামের সাথে আমার সম্পর্কে কটুক্তি করে বলেছো, তুমি আমাকে পছন্দ করো না। আমাকে এমন অপদস্ত করার হেতু কি? সে প্রথমে আমাকে খুব ধমকালো, পরে আবার হাতজোড় করে মিন মিন করতে লাগল। আমি ওকে পরিষ্কার বলে দিয়েছি, ‘পিতার মর্যাদা রক্ষার খাতিরে আমি তোমার বাগদত্তা হতে রাজী হয়েছিলাম। তাকে বললাম, এ ব্যাপারে তুমি আব্বার সাথে কথা বল।‘
রাতে আব্বা আমাকে একাকী ডেকে বললেন, সুবক্তগীন আমার কাছে। তআমাদের পূর্বাপর সব ঘটনা বলে দিয়েছে। আব্বা তোমার অকপট সত্যবাদিতায় দারুণ খুশি হয়েছেন। তোমার সাহসী উচ্চারণের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। আমি আব্বাকে বলে দিয়েছি, এই বাগদত্তা আমার একদম সহ্য হয় না। অবশ্য সে খুব বড় অফিসার। মনে হয় আজ দিনের কোন এক সময় সে আব্বার সাথে এ নিয়ে কথাও বলেছে।
সুবক্তগীন তরুণীকে গভীরভাবে দেখছিল। গতকালের চেয়ে আজ তাকে আরো বেশি সুন্দরী মনে হচ্ছিল। তরুণী সুবক্তগীনের হাত তার হাতে নিয়ে খেলছিল আর সুবক্তগীনও গভীর দৃষ্টিতে তাকে পরখ করছিল। তারা পাশাপাশি ঘনিষ্ঠ হয়ে বসেছিল। তরুণী তার শরীর ঘেষে বসে চোখে চোখ রেখে অনর্গল কথা বলছিল। সুবক্তগীন তরুণীর কথা ও রূপ-সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে বলল, “তোমাকে দেখলে, তোমার কথা শুনলে আমার মায়ের কথা মনে পড়ে।”
“তোমার ছেলেও এই কথাই বলবে।” বলে খিলখিলিয়ে হেসে উঠল তরুণী।
সূর্য নদীর ওপারের টিলার আড়ালে শেষ আলো বিকিরণ করে ডুবে যাচ্ছে। পশ্চিমাকাশে সূর্যের লালিমা ঘন অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে। আর এপারে দু’ যুবক-যুবতী হাতে হাতে ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনছে।
মাসখানিক পেরিয়ে গেছে। এরই মধ্যে আলগুগীনের হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে নিল সুবক্তগীন। আলপ্তগীন তাকে একান্ত সচিবের মর্যাদায় অভিষিক্ত করে বললেন, “মুসলিম জাতির চেতনা নষ্ট হয়ে গেছে। শাসকশ্রেণী আরাম-আয়েশ ও ভোগ-বিলাসিতায় আকণ্ঠ ডুবে আছে। রাজ্যগুলো প্রতিদিন টুকরো টুকরো হচ্ছে। বেঈমান আমীররা প্রধান শাসককে ভোগবাদে নিমজ্জিত করে বিচ্ছিন্নতার বীজ বপন করছে জাতির মাঝে। আমাদের নেতারা বেঈমানদের দেয়া পুরিয়া গিলে পরস্পর খুনোখুনিতে লিপ্ত হয়েছে। যে খেলাফত ছিলো মুসলমানের সকল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র তা এখন খেয়ালী রাজার সিংহাসনে পরিণত হয়েছে। সুলতান আব্দুল মালেক আমাদের কেন্দ্রীয় শাসক। তিনি বহাল তবিয়তে বেঁচে আছেন। অথচ তার সিংহাসন নিয়ে উত্তরাধিকারদের মধ্যে এখনই বিবাদ শুরু হয়ে গেছে। আমরা চাচ্ছি, সুলতানের অবর্তমানে তার কনিষ্ঠ ছেলেকে সিংহাসনে বসাব। কিন্তু বড় সাহেবজাদা আমীর মনসুর তা কখনও হতে দিতে চাইবেন না। এই ফাঁকে আমি গজনীকে কেন্দ্র করে স্বাধীনতা ঘোষণা করব।”