বহুদিন পরে তার সুপ্ত বেদনা আবার উথলে উঠল, স্মৃতিগুলো ভাস্বর হয়ে দৃশ্যমান হতে থাকল। জীবনে মা ছাড়া তার অনুভবে কোন নারীর অস্তিত্ব নেই। মনে পড়ে গেল, ছোটবেলায় মায়ের কোলের উষ্ণতা পেলে প্রশান্তিতে ভরে যেতো তার দেহমন। মা তাকে পরম স্নেহে বুকে জড়িয়ে ঘুম পড়াতেন, কোলে নিয়ে আদর করতেন, তার স্বপ্নের কথা বলতেন, খ্যাতিমান হওয়ার সোনালী ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখাতেন। আর আজ এই তরুণী তার মায়ের স্বপ্নেরই পুনরাবৃত্তি করছে। একই আকাক্ষার প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে ওর কণ্ঠে।
অথচ সে এই যুবতাঁকে যখন পিঠে করে নদী থেকে উদ্ধার করেছিল, তখন তরুণী তার গলা জড়িয়ে ধরেছিল দু’হাতে, তার ভেজা বসন লেপ্টে গিয়ে শরীরের ভাজ ও নারী চিহ্নগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো। কিন্তু একটি বিপদাপন্ন তরুণীকে উদ্ধারের ব্রত ভিন্ন কিছুই তখন ভাবতে পারেনি সুবক্তগীন। তরুণীর তপ্তশ্বাস ও হৃদয় মোহিনী হাসিও তার মধ্যে কোন তারল্যের উদ্ভব ঘটাতে পারেনি। কিন্তু এখন কী হলো, সব কিছুই যেন ওলট-পালট হয়ে গেল। অজানা ভবিষ্যত, আবাল্য স্বপ্ন, মায়ের সাধ আর তরুণীর নিবেদনে কেমন যেন উদভ্রান্ত করে তুলছে তাকে প্রতিক্ষণ। প্রচণ্ড এক আলোড়ন অনুভব করছে মনের মধ্যে সুবক্তগীন। তরুণীর কথাগুলো বারবার কানে বাজছে তার। সে ঠিকই বলেছে, সম্পদ ও ক্ষমতার সুযোগে আমীর-উমারার হেরেমগুলো জাহান্নামে পরিণত হয়েছে। যে নারী ছিল প্রশান্তির আধার, তাদের আজ শারীরিক উত্তেজনা উপশমের উপাদানে পরিণত করা হয়েছে।
পুৰুষ আজ আর এক নারীতে তৃপ্ত নয়। ধৈর্য, স্থিরতা, নীতি, আদর্শ, বীরত্ব, বাহাদুরী সবই শাসক শ্রেণীর লোকেরা মদ আর নারী ভোগে খুইয়ে ফেলেছে। শুধু নারীসঙ্গ ভোগের জন্যে মুসলিম সমাজের মাথাগুলো রাজা-বাদশাহকে তোষামোদ করে দামী উপঢৌকন দেয়, শাসকদের মধ্যে বিরোধ বাধায়, নিজের জাতি-ধর্মের ইজ্জত হুরমত ধুলায় লুটিয়ে দিয়ে ঈমানের সওদা করে। তারপরও যখন স্বস্তি পায় না, নিশ্চিত করতে পারে না দূরাকাতক্ষা, তখন কওম ও জাতির সর্বনাশ করতে গিয়ে দুশমনদের ভূতখানায় হাজিরা দিয়ে স্বস্তি আর সুখ নিশ্চিত করে। অধঃপতনের এসব কিছুর শুরুটা নারীর থেকেই ঘটে। মুসলিম মাতৃত্বকে হত্যা করে পুরুষের ঔরসকে কলঙ্কিত করে আমীর-উমরা শ্ৰেণী শুধু নিজেদের অস্তিত্বের ভিতে ধসই নামায় না, মাযহাব ও মিল্লাতের ভিত্তিকেও গুঁড়িয়ে দেয় আমিও কি সে পথেই অগ্রসর হচ্ছি। অবশ্য ভোগবাদীরা সমূলে ধ্বংস করতে চাচ্ছে এই শক্তিটাকে।
“নারী কোন সৌন্দর্য বর্ধনকারী বিলাস সামগ্রী নয়, নারী নির্মলতার প্রতিচ্ছবি, অফুরন্ত জীবনী শক্তির আধার।” তরুণীর আবেগাপ্লুত এই কথাগুলো তোলপাড় সৃষ্টি করে সুবক্তগীনের মনে।
সুবক্তগীনের মনে পড়ল তার মায়ের স্মৃতি। এক আমীর বহু মূল্য, বিলাস-ব্যসন ও মণি-মুক্তার টোপ দিয়ে তার মাকে খরিদ করতে চেয়েছিল। কিন্তু তার পূতঃপবিত্র মা সোদানা মণিমুক্তা আর বিলাস ব্যসনকে লাথি মেরে ঝুপড়িতে ফিরে এসেছিলেন ভিখারিণীর বেশে। নিজের আদর্শ ও পবিত্রতা রক্ষায়, ইসলাম ও ঈমানের শুভ্রতা রক্ষায় সর্ব ফেলে পথে নেমেছিলেন স্বামীকে নিয়ে। তবুও নিজের বিশ্বাস ও পবিত্রতাকে কলঙ্কিত হতে দেননি। জাগতিক সুখের সওদা করেননি ঈমানের রত্ন দিয়ে। আলপ্তগীনের মেয়ের মতো তার মাও চেয়েছিলেন এক বাহাদুর সন্তানের মা হতে। রক্ষিতা হতে চাননি কারো। তার মনে বাবার মতোই সংশয় দোলা দিল, “মেয়েরা কি তাহলে এমন স্বপ্নবিলাসী, কল্পনাপ্রবণই হয়ে থাকে?” পরক্ষণেই মনে পড়ল উস্তাদজীর কথা। উস্তাদজী বলেছিলেন, “ন্যায় ও আদর্শের প্রতীক নওশেরোয়াও মায়ের উদরেই জন্ম লাভ করেছেন। নারীকে যদি তামাশা আর ভোগের পণ্য বানিয়ে ফেলা হয় তবে তাদের গর্ভে আর জন্ম নেবে না তারেক, মুসা ও নওশেরোয়া।”
গভর্ণর হাউজ থেকে বেরিয়ে ঘোড়ার লাগাম ধরে অধমুখে আস্তাবলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে ইত্যাকার ভাবনায় ডুবে যায় সুবক্তগীন। সেই সাথে তরুণীর প্রতি একটা আকর্ষণ অনুভব করল মনের গহীনে। মনে মনে বলল, অনন্য এই তরুণী। ওর সাথে অন্য হেরেমের অন্য ললনাদের তুলনাই অর্থহীন। তরুণী তাকে বলেছে, সে আবার আমার সাথে দেখা করতে অবশ্যই আসবে। এসব কথা ভেবে তরুণীর মধ্যে কেমন যেন আস্থা অনুভব করল সুবক্তগীন।
এই দাঁড়াও!
আধো প্রেম, আধো সংকট, আশা-নিরাশার দোলাচলে দুলতে দুলতে আনমনে হাঁটছিল সুবক্তগীন। জগতের অন্য কিছুর প্রতি খেয়ালই ছিল না তার। হঠাৎ কর্কশ ডাকে সম্বিত ফিরে দেখল, তরুণীর বাগদত্তা দ্রুত পায়ে তার দিকে আসছে। সে দাঁড়াল।
রক্তচক্ষু আগন্তুকের। গর্জে উঠে সুবক্তগীনের উদ্দেশে বলল, হাজী নসর-এর বিক্রিত গোলামকে যেন আর কোনদিন শাহজাদীর আঙ্গিনা মাড়াতে না দেখি। তুমি যদি বুখারার শাসনকর্তার মেয়েকে নদী থেকে উদ্ধার করেও থাকে, সেটা তোমার আহামরি কোন বাহাদুরি নয়। এ ছিল তোমার কর্তব্য। এই কর্তব্য পালন না করলে বরঞ্চ আমরা তোমাকে জেলখানায় আটকে না খাইয়ে হত্যা করতাম। এ কাজের জন্যে পুরস্কারের যোগ্য নও তুমি।
আমি গোলাম নই, স্বাধীন। বরঞ্চ গোলাম আপনি। খুব মৃদু অথচ দৃঢ়কণ্ঠে বলল সুবক্তগীন।