কোথা থেকে আসা হচ্ছে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে তরুণীর দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল লোকটি। এই ছোড় কে?
হু, আপনি কে যে একেবারে হাকিমের মতো জেরা শুরু করেছেন? তাচ্ছিল্যের সুরে জবাব দিল তরুণী। আমার ঘোড়া বেসামাল হয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে, রেকাবীতে পা আটকে আমি পড়ে গিয়েছিলাম। এ লোক আমাকে উদ্ধার করেছে। বুঝলেন হাকিম সাহেব! কিছুটা তাচ্ছিল্য বর্ষণ করে তরুণী সুবক্তগীনের বাজু ধরে তাকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেল।
এ লোক কে? তরুণীকে জিজ্ঞেস করল সুবক্তগীন। আমার বাগদত্তা। এখন থেকেই আমার উপর তিনি কর্তৃত্ব চালাতে চাচ্ছেন, কথায় কথায় হুকুম করেন, আগ বেড়ে খবরদারী চালান। কিছুটা শ্লেষমাখা কণ্ঠে বলল তরুণী। তুমি একে পাত্তা দিও না, ভয় করারও কিছু নেই।
হঠাৎ তরুণী সুবক্তগীনের বাজু ধরে বলল, তোমার কি স্ত্রী আছে, তুমি কি বিবাহিত?
না।
কোন মেয়েকে কি তোমার পছন্দ হয়নি? কারো সাথে কি তোমার ভাব নেই?
না। মেয়েদের প্রতি আমি কখনও দৃষ্টি দেই নি। এই সুযোগও আমার নেই।
তরুণী আবেগপ্রবণ হয়ে বলল, আমাকে কি তোমার ভালো লাগছে না? নিরুত্তর সুবক্তগীন। তরুণীর কথায় সে দৃষ্টি অবনত করে ফেলল।
হু, তুমি আমাকে বেহায়া মনে করছে, তাই না? বলল, বলল সুবক্তগীন! যদি তুমি আমাকে বেহায়া ও বখাটে মেয়ে ভেবে থাকো তাহলে আর কখনও তোমার দৃষ্টিসীমায় আসবো না।
তোমাকে ভাল লাগা না লাগার কি আছে, তুমি তো আরেকজনের বাগদত্তা!
এটা আমার পারিবারিক পছন্দ। ওই না-মরদটাকে আমি একদম সহ্য করতে পারি না। সে আমাকে দাসী বানাতে চায়। সে আমাকে ঘোড়-সওয়ারী হতে বারণ করে। সে চায়, আমি শুধু তার হেরেমের শোভা বর্ধন করি। চার দেয়ালের ভেতরে আবদ্ধ হয়ে থাকি। ওসব আমার অসহ্য। আমি চাই এমন। লোক যে তোমার মতো সুপুরুষ, যে আমার পাশাপাশি ঘোড়া দৌড়াবে, নদীতে ঝাঁপ দেবে। ওসব আয়েশী রাজা-বাদশাহদের বুঝিয়ে দিতে চাই, নারী শুধু হেরেমের শোভা বর্ধনের উপকরণ নয়, নারীর দেহ শুধু পুরুষের কামরিপু চরিতার্থ করার ক্ষেত্র নয়। তারা নারীকে ভোগের দাসী বানিয়ে নিজেরা মদে ডুবে থেকে ইসলামের অপমান করছে। আমি বুঝিয়ে দেব, ইসলাম নারীকে দিয়েছে মাতৃত্বের সম্মান, স্বাধীনভাবে জীবন যাপনের অধিকার। সমাজ-সংসারে নারীরও দায়িত্ব আছে। সেও দেশ, সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে ভাববার দাবিদার। আমি ওদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চাই, হেরেমের বাইরে বের হলেই নারী নষ্ট হয়ে যায় না, এতে নারীর শাশ্বত সত্তার পবিত্রতাও নষ্ট হয় না। ওরা চায়, নারীরা হেরেম নামের জিন্দান খানায় বাইজী হয়ে বহু পুরুষের ভোগের সামগ্রী হোক। ওদের ধারণা, নারী হলো শুধুই ভোগের বস্তু। তারা মনে করে, কর্তৃত্ব আর বীরত্বের তকমা গলায় বেঁধে দাস-দাসী ও বাইজীর আসর জমানোই হলো বীরত্ব। নারীও যে সত্যিকার অর্থে বীরত্বপূর্ণ কাজ করতে পারে, পারে ইসলামের সেবায় নিজেকে উজাড় করে দীনের স্তম্ভকে শক্তিশালী করতে তা ওরা ভুলে গেছে। আজ মুসলিম নেতৃবর্গ ইজ্জত নয় জিন্নতির জীবন যাপন করছে। কেন, এর কারণও ওরা খুঁজে দেখতে চাচ্ছে না। মুমেন নারী যে বিরাট শক্তির আধার তা নতুন করে ওদের আমি জানিয়ে দিতে চাই।
সুবক্তগীন! মদে-মাতাল ওসব শাসকের হেমেরে কখনও বীরপুরুষ জন্ম নিতে পারে না, ওদের ঘরে কাপুরুষই বেড়ে ওঠে। ইসলামের পতাকা বহন করার হিম্মত ওদের হয় না। ওদের জন্মই ইসলাম অবমাননার কারণ। আমি এমন সন্তানের মা হতে চাই, যে ইসলামের খাদেম হবে, ইসলামকে পৃথিবীর প্রান্তসীমা পর্যন্ত বিস্তৃত করবে। শুধু আলেম ও মুবাল্লিগের বেশে নয় বিজয়ী বীরের বেশে। কূটনীতিতে সে সফল হবে, যার তরবারীতে শক্তি বেশি থাকবে। একনাগাড়ে কথাগুলো বলে ক্ষোভে উত্তেজনায় হাঁফাতে লাগল তরুণী।
আমার মাও তোমার মতোই স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু তার স্বপ্নের ছেলে দাস হিসেবে আদম বাজারে বিক্রি হয়ে গেছে।
ইসলামের ঝাণ্ডাবাহী তোমার মতো গোলাম আর আমার আব্দুর মতো আদর্শবান দাসরাই হতে পারে। কেন, আমার আন্ধু তোমাকে বলেননি যে, তিনিও তোমার মতোই আদম বাজারে দাস হিসেবেই বিক্রিত হয়েছিলেন। কিন্তু নিজের কর্মনিষ্ঠা ও সতোর জোরে আজ তার অবস্থান এবং মর্যাদা দেখো। দেখো তাঁর কর্মতৎপরতা ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা।
তোমাকে কে বললো যে, তোমার গর্ভে যে ছেলের জন্ম হবে সে বাহাদুর এ আর দীনের সিপাহসালার হবে। এটা তোমার তারুণ্যের আবেগ, যৌবনের ও আকাক্ষা।
এটা আমার হৃদয়ের আকাক্ষা, দীর্ঘ দিনের লালিত বাসনা। এটা আমার অস্তিত্বের চাওয়া, আমার নারী মনের আর্তি। আমার এই আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন-সাধকে তুমি যৌবনের আবেগ, শব্দের ব্যঞ্জনা আর খেয়ালীপনা মনে করো না সুবক্তগীন! হ্যাঁ। তুমি আমার ভালবাসাকে উপেক্ষা করতে পারো, কিন্তু আমার ইচ্ছা ও পবিত্র আকাঙ্ক্ষাকে অপমান করো না। আমি ওই গবেটটাকে কিছুতেই স্বামীত্বে বরণ করতে পারবো না। আবেগ ও উত্তেজনায় কথাগুলো বলতে বলতে কেঁদে ফেলল তরুণী।
সুবক্তগীন ওখান থেকে বেরিয়ে এলো। মনের মধ্যে তার তুমুল ঝড়। জীবনের গতি সম্পর্কে এখনও সে স্থির নয়। বুঝে উঠতে পারছিল না, আশৈশব লালিত তার আকাঙ্ক্ষা ও মায়ের স্বপ্ন বাস্তবরূপ লাভ করবে কিনা। এমন সময় এই তরুণীর কথা তার হৃদয়ে চেপে থাকা দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষাকে আরো তীব্র করে তুলল। সুবক্তগীন কল্পনাও করতে পারেনি, কোন রাজ হেরেমে এমন ঈমানদীপ্ত তরুণী থাকতে পারে, ইসলামী ঈমান আকীদার দুর্গরূপী এমন মেয়েও জগতে আছে।