সুবক্তগীন তখন তার দরবারে মাথা নীচু করে ক্রীতদাস হিসেবে দণ্ডায়মান। মনিবের প্রশ্নের জবাবে নিরুত্তর।
তুমি আমাকে তোমার আদব-আখলাক দিয়ে বুঝাতে চাচ্ছো যে, তুমি গোলাম হিসেবে খুবই বিশ্বস্ত হবে, তাই না?
আলপ্তগীন ধীর পায়ে গোলামের কাছে এসে পিঠে আলতো চপেটাঘাত করে জোর গলায় বললেন, বেটা! মাথা উপরে উঠাও, বুকটান করে দাঁড়াও, আমার চোখে চোখ রেখে দেখ, আমিও তুর্কী, তুমিও তুর্কী।
সুবক্তগীন মাথা তুলে মনিবের দিকে তাকাল। মনিব তাকে নিজের কাছে বসিয়ে বললেন, তুমি যেমন বুদ্ধিমান, তের্মনি সৎ ও কৌশলী যোদ্ধা। আসলে মানুষ শুধু জ্ঞানের দ্বারা আলেম হতে পারে না, শুধু আমল দ্বারাও পূর্ণ মানুষ হতে পারে না। মানব জীবনে ইলম ও আমলের সমন্বয় থাকতে হয়। আরো একটা ব্যাপার আছে, ইলম থাকা সত্ত্বেও আমল বিশুদ্ধ হয় না যতক্ষণ না সে ব্যক্তি কোন বুযুর্গ ব্যক্তির নির্দেশনামতো নিজেকে গঠন করে। তোমার সৌভাগ্য যে তুমি জন্মসূত্রে ধর্মীয় চেতনা পেয়েছ আর দু’জন বুযুর্গ ব্যক্তির সংস্পর্শে দীক্ষা নিয়েছ। তোমার মধ্যে ইলম ও আমলের সমন্বয় ঘটেছে। এটা বড় গুণ।
আমার মধ্যে এমন কোন গুণ নেই যা দেখে বুখারার গভর্ণর মুগ্ধ হতে পারেন। বলল সুবক্তগীন।
এটাই তো তোমার বড় গুণ যে, তুমি একই সাথে তুর্কী ও গোলাম । তোমার মত আমিও তুর্কী এবং গোলাম ছিলাম। ছোটবেলায় আমাকেও এমন কঠিন দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে যেমন কঠিন গোলামীর জীবন তুমি বয়ে চলেছ। তবে তুমি জন্মসূত্রে মুসলিম আর আমার মা-বাবা ছিলেন অমুসলিম। আমি গোলাম অবস্থায় মুসলমান হয়েছি। আমি দীর্ঘদিন একজন বুযুর্গ ব্যক্তির মুখে ইসলামের নীতি ও আদর্শের কথা শুনেছি। ইসলামের কথা শুনে শুনে আমার মন সত্যধর্ম গ্রহণের জন্যে ব্যাকুল হয়ে ওঠে। একদিন সেই বুযুর্গের হাতে হাত রেখে ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হয়ে গেলাম।
ইসলাম বলে, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ নেই। কেউ কারো প্রভু অথবা গোলাম নয়, টাকায় বিক্রি হওয়ার পণ্য নয় মানুষ । আল্লাহর জমিনে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব করবে মানুষ। নিজের মর্জি মতো মানুষের উপর প্রভুত্ব করার অধিকার কোন শাসকের নেই। শাসকরা প্রভু নয় সেবক। আমি যদি মুসলমান না হতাম, আমার মনে যদি ইলম ও আমলের তৃষ্ণা সৃষ্টি না হতো, তাহলে হয়তো আজো গোলামই রয়ে যেতাম, এ সম্মান ও ক্ষমতার আসন পর্যন্ত পৌঁছা সম্ভব হতো না আমার।
সুবক্তগীন বললো, আমার আম্মু আমাকে বলতেন, তুমি বড় হলে অনেক সুনাম কুড়াবে। তোমার তরবারীর আঘাতে মিথ্যা অপসারিত হবে। তিনি আমাকে কুরআনের সেই আয়াত সম্পর্কে বলতেন যা হযরত ইবরাহীম তার পিতাকে বলেছিলেন, “আপনি এই সব জড় পদার্থের পূজা করেন যেগুলো শোনে না, বলতে পারে না, কিছু করতে পারে না। আপনি আমার সাথে আসুন। আমি আপনাকে সঠিক পথে নিয়ে যাব।” আর আমার মা আমাকে বলতেন, “তুমি সে সব মূর্তি পূজারীদের সেই পবিত্র মা’বুদের পথ দেখাবে যিনি ছাড়া আর কোন মা’বুদ নেই এবং হযরত মুহাম্মদ (স.) তাঁর বান্দা ও রাসূল (স.)।” আমার মা’র এসব কথা শুনে আব্বা বলতেন, “তোমার মা’র আকীদা সঠিক কিন্তু তার আকাক্ষা অলীক। কারণ, গরীবের সন্তান সুখ্যাতি পায় না, ওদের মধ্যে সত্যনিষ্ঠা, বীরত্ব থাকে না, তারা হয় পরমুখাপেক্ষী ও কাপুরুষ। সুখ্যাতি অর্জন করতে হলে বীরত্ব, সত্যনিষ্ঠ হতে হয় এবং শাসক রাজা-বাদশাহদের সাথে মোকাবেলায় অবতীর্ণ হতে হয়। ন্যায় নিষ্ঠা দিয়ে মানুষকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করতে হয় কিন্তু গরীবের সন্তানদের চরিত্রে এসব বৈশিষ্ট্যের সমন্বয় ঘটে না, ঘটাতেই পারে না, সৎ গুণাবলী অর্জনের সুযোগই তারা পায় না।”
আলপ্তগীন বললেন, তবে আমি বিশ্বাস করি, গরীবের সন্তানও বড় হতে পারে। কেন পারবে না, আরবের বেদুইন উট ও মেষ রাখালরা যদি সত্যের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে আধা পৃথিবীর রাজত্ব করতে পারে তাহলে তুমি কেন পারবে না? বুঝতে হবে, যাযাবরের সন্তানরা এবং গোলাম হওয়ার পরও তুমি এখন আমার সাথে পাশাপাশি বসে আছ। কোন জাত-গোলাম এমনটি স্বপ্নেও ভাবতে পারে না। আমার মনে হয়, তোমার মায়ের স্বপ্ন সফল হবে। তোমার বিশ্বাস, আস্থা ও কর্মনিষ্ঠা তোমাকে এ পর্যায়ে উন্নীত করেছে। আমি তোমার মধ্যে বিপুল সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি। তুমি যদি চেষ্টা কর তবে জীবনে উন্নতি করতে পারবে অবশ্যই।
আমার নিজের জন্যে কোন চাহিদা নেই। কোন পদ-পদবীর আগ্রহ আমার নেই। তবে আমি অবশ্যই একটা কিছু প্রত্যাশা করি, কিন্তু সেটা কি তা বুঝাতে পারবো না। বলল সুবক্তগীন।
হেসে ফেটে পড়লেন আলপ্তগীন। বললেন, এমন অবস্থা আমারো গেছে। আমিও বুঝে উঠতে পারতাম না আমার কি করা উচিত। সময়ই আমাকে বলে দিয়েছে আমার কি করণীয় ও কর্তব্য। তুমিও অচিরেই বুঝতে পারবে, কি তুমি চাও, কি তোমাকে করতে হবে। আজ থেকে তুমি নিজেকে আর গোলাম মনে করো না। এখন থেকে তুমি স্বাধীন। শুধু স্বাধীন নও, আমার প্রশাসনের একজন সম্মানিত জিম্মাদার ব্যক্তি।
সুবক্তগীনের হৃদয়ে ছিল এক সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। মিথ্যাকে দূর করে সত্যের বিজয় কেতন উড়ানো, মানুষের বিশ্বাসের নোংরামি দূর করে তাদের সঠিক পথের দিশা দেয়া এবং সুন্দরের প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্যে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা তার হৃদয়ে যেন অগ্ন্যুৎপাত ঘটাতে চাইত কিন্তু পরিস্থিতি তাকে দমিয়ে রাখতো। এতটুকু সে বুঝতো, একটি নির্ভেজাল, সুন্দর, সত্য দিন দিন তার মধ্যে পুষ্ট হচ্ছে, বেড়ে উঠছে। তারুণ্য যৌবনের তাড়না তার মাঝে ছিল না এমন নয়, কিন্তু তা কখনও তাকে আদর্শচ্যুত করতে পারত না। সে প্রচণ্ডভাবে অনুভব করছে, বিপ্লব তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। এক যুদ্ধ-বিজয় তার হৃদয়ে তোলপাড় শুরু করে দিয়েছে।