হাজী নসরের এক ছেলে কুরআন শরীফ ভুল পড়ছিল। সুবক্তগীন তার ভুল নিজে না শুধরিয়ে গৃহশিক্ষকের কাছে গিয়ে বলল, সাহেবজাদা ভুল পড়ছে। গৃহশিক্ষক সুবক্তগীনের উপস্থিতবুদ্ধি ও বিদ্যা দেখে বিস্মিত হলেন এই ভেবে যে, এই পুঁচকে ভৃত্য কুরআন শরীফের ভুলও ধরতে পারে। তিনি সুবক্তগীনকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কুরআন শরীফ পড়া কোথায়, কার কাছে শিখেছ? জবাবে সুবক্তগীন গৃহশিক্ষককে তার মা-বাবা, উস্তাদ এবং তার অপহরণের সব ইতিবৃত্তই শোনাল। গৃহশিক্ষক সুবক্তগীনের আচরণ ও কথাবার্তায় মুগ্ধ হলেন এবং তার প্রতি একটু বেশি মনোযোগী হয়ে পড়লেন। কিন্তু হাজী নসর এদের এতটুকুই লেখাপড়া শিখাতে ইচ্ছুক ছিলেন যতটুকু করলে সৈনিক ও সিপাহী হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। এদের জন্য এর বেশি শিক্ষাকে তিনি নিজের জন্যে ক্ষতিকর ভাবছিলেন।
নিজ সন্তানদের শিক্ষার ব্যাপারেও হাজী সাহেবের একটা সীমা নির্ধারিত ছিল। যতটুকু লেখাপড়া করলে ধর্মের জরুরী জ্ঞান লাভ করা যায় আর যে সব কলাকৌশল রপ্ত করলে তেজস্বী অশ্বারোহী, বীর সেনাপতি আর বাহাদুর যোদ্ধা হওয়া সম্ভব ছেলেদেরকে তিনি এই পরিমাণ যুদ্ধকৌশল ও বিদ্যা শেখানোর জন্যে দায়িত্ব দিয়েছিলেন গৃহশিক্ষকের উপর । কিন্তু হাজী নসর-এর ছেলেদের কেউই সুবক্তগীনের মতো দূরদর্শী এবং মেধাবী ছিল না। যুদ্ধ বিদ্যা, তীর চালানো, ঘোড় সওয়ার কি পুঁথি-পুস্তক কোন ব্যাপারেই খুব একটা আগ্রহ ছিল না হাজীপুত্রদের মধ্যে। পক্ষান্তরে কিছু দেখে, কিছু শুনে এবং কিছুটা নির্দেশনা পেয়েই সুবক্তগীন দ্রুত যুদ্ধ কৌশল, ঘোড় সওয়ার ও তীর ধনুক-তরবারী চালনায় সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠছিল।
গৃহশিক্ষক যেমন সুবক্তগীনের প্রতি ঝুঁকে পড়লেন, অন্য ছেলেরাও সুবক্তগীনের প্রতি সশ্রদ্ধ ছিল। সে কথা বলতে সহাস্যবদনে। কখনো কাউকে কটাক্ষ করে কথা বলতো না। তার আচরণ ও মার্জিত ব্যবহার শিক্ষককে তার প্রতি মনোযোগী করে তুললো। শিক্ষক তার অভিজ্ঞতা ও পাণ্ডিত্য উজাড় করে দিয়ে তাকে জ্ঞানের রাজ্যে ডুবিয়ে দিতে লাগলেন। মাত্র তিন বছরে হাজী নসরের আশ্রয়ে পরিপূর্ণ যোদ্ধায় পরিণত হয় সুবক্তগীন। শিক্ষক তাকে ইসলামী ইতিহাস ও ঐতিহ্যেরও শিক্ষা দেন। অপরদিকে আয়েশী হাজীপুত্ররা সুবক্তগীনের কৃতিত্বে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ না হয়ে ভোগ-বিলাসিতায় তলিয়ে যেতে থাকে।
দীর্ঘ সফর থেকে ফিরে হাজী নসর যখন সুবক্তগীনকে দেখলেন, তখন মনে হলো তিনি অন্য কাউকে দেখছেন। কৈশোর পেরিয়ে সে তখন পূর্ণ স্বাস্থ্যবান সুঠাম যুবকে পরিণত হয়েছে। একদিন হাজী নসর সুবক্তগীনের যুদ্ধকৌশল, তীরন্দাজী ও অশ্বারোহণ দেখে বিস্মিত ও মুগ্ধ হলেন। সুবক্তগীনের সমর নৈপুণ্যে হাজী নসর তাকে তার নিজস্ব রক্ষী বাহিনীর দলনেতা এবং গোলামদের তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব দিলেন। অল্পদিনের মধ্যেই সুবক্তগীন হাজী নসর-এর ডান হাতে পরিণত হল।
সে সময় আলপ্তগীন বুখারার গভর্ণর ছিলেন। তুর্কী খেলাফতের মসনদে দ্বিতীয় আব্দুল মালেক সমাসীন। হাজী নসর আলপ্তগীনের খুব প্রিয়ভাজন ছিলেন। এক তথ্য মতে ৯৫৭ সাল মোতাবেক ৩৪৮ হিজরীতে একদিন হাজী নসর আলপ্তগীনের সাথে মোলাকাত করতে গেলেন। সে সময় সুবক্তগীনও সাথে ছিল। তখন সুবক্তগীনের বয়স বিশ-একুশ বছর। ইতিহাসে হয়তো এটাই প্রথম ঘটনা যে, কোন যাযাবরের অপহৃত ছেলে গোলাম হিসেবে বিক্রি হওয়ার পরও বুখারার গভর্ণর হাউজে প্রবেশাধিকার পেল। সাক্ষাতের পর আলপ্তগীন হাজী নসরকে বললেন, আপনি এই গোলামকে আমার হাওলা করে দিন। আলপ্তগীন বিভিন্ন সূত্রে হাজী নসর আশ্রিত সুবক্তগীনের কর্মকুশলতার সংবাদ আগেই পেয়েছিলেন। সাক্ষাতে সুবক্তগীনকে দেখেই তিনি আঁচ করতে পেরেছিলেন, এই যুবকের মধ্যে প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। তাছাড়া আলগীনের কন্যা ছাড়া প্রশাসনিক দায়িত্ব গ্রহণ করার মতো কোন যোগ্য উত্তরাধিকারও তার নেই। তিনি মনে মনে এমন যোগ্য এক উত্তরসূরি খুঁজছিলেন।
কিন্তু এমন দামী রত্ন হাজী নসর হাতছাড়া করতে কোন মতেই রাজী ছিলেন না। অনেক বলা কওয়ার পর অভাবনীয় উচ্চমূল্যের প্রস্তাব দিলে হাজী নসর সুবক্তগীনকে হস্তান্তর করতে সম্মত হলেন।
সে সময় আলপ্তগীন, সুবক্তগীন ধরনের নাম সাধারণত তুর্কীরা রাখতো। সুবক্তগীনের মা তুর্কী হওয়ার কারণে ছেলের নাম তুর্কী ধাচে রেখেছিল। সে সময় তুরস্কের শাসন ক্ষমতা ছিল অমুসলিমদের হাতে। শাসকদের অত্যাচার-উৎপীড়নে মুসলমানরা তুরস্ক ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যাচ্ছিল। দেশ ছাড়াদের মধ্যে সুবক্তগীনের মায়ের বাপ-দাদাও ছিল।
দৈহিক সৌন্দর্য আর মেধা-মননে তুর্কীরা ছিল অন্যদের তুলনায় আকর্ষণীয়। এ জন্য ডাকাত ও লুটেরাদের হাতে বন্দী হয়ে যেসব তুর্কী বিক্রির জন্য হাটে উঠত তাদের দাম অন্যদের চেয়ে বেশি হতো। বলখ, গজনী, বুখারা ও আশ-পাশের এলাকায় বহু তুর্কী গোলাম-বাদী পাওয়া যেতো। দেশ জুড়ে এদের গোলামীর সুখ্যাতি ছিল। এরা খুবই বিনয়ী, অনুগত ও বিশ্বস্ত। মুনিবের স্বার্থ রক্ষায় এরা অতুলনীয়।
তুমি কি সে সব গোলাম বংশের, যাদের বেলায় এই অঞ্চলের বেশ সুখ্যাতি রয়েছে? আলপ্তগীন সুবক্তগীনকে জিজ্ঞেস করলেন।