এই কিশোরী দল এখানে বিক্রিপণ্য। কাফেলা লুটের শিকার । উঁকি ঝুঁকি দিয়ে ওদের শরীর আর চেহারা পরখ করছে ক্রেতাদল। আমির-উমরার হেরেমের রক্ষিতা, আদম ব্যাপারী ও মেয়েদের ফেরীওয়ালা, যারা ওদের নাচ-গান শিখিয়ে বাজারে বাজারে ব্যবসা করে এমন লোকেরা এখানকার ক্রেতা।
একটু দূরে একটি টিলাসদৃশ জায়গায় আরেকটি জটলা। ওখানে বালক, শিশু আর পুরুষদের হাট। ক্রেতারা গরু-ছাগলের মতো ওদের নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখছে। অপেক্ষাকৃত কমবয়সী বালকদের দাম বেশি। দশ বারো বছরের কয়েকটি বালক অঝোর ধারায় অবিরাম কাঁদছে। একটি ছেলে ওদের ব্যতিক্রম। অন্যেরা কাঁদলেও তার মধ্যে কোন ভাবান্তর নেই। নিরুদ্বেগ, গম্ভীর। এসব বালককে বণিক কাফেলা থেকে অপহরণ করা হয়েছে- যে কাফেলার সাথে আল-হাকাম তাঁর স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বুখারার পথ ধরেছিল। নিরুদ্বেগ বালকটিই সুবক্তগীন। দেখতে সে অন্য বালকদের মতো ফর্সা না হলেও প্রাণবন্ত। সুস্থ সবল চেহারায় তার আভিজাত্যের ছাপ।
ক্রেতাদের মধ্যে হাজী নসর-এর প্রতিনিধিও উপস্থিত। হাজী নসর বুখারার উপকণ্ঠের এক জমিদার লোক। সে তার প্রতিনিধিদের বলেছিল, বয়স্ক গোলামের চেয়ে তার দরকার কমবয়েসী কয়েকটি বালক। যাদের তিনি নিজের মতো করে প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তুলবেন, আস্থাভাজন হিসেবে নিজের বিশেষ কাজে ব্যবহার করবেন। সুবক্তগীনকে দেখে হাজী নসরের প্রতিনিধিদের পছন্দ হলো। তাকে খবর দিলো। হাজী নসর এসে বালকদের কান্না দেখে হতাশ হলেন, কিন্তু নির্বিকার শান্ত-সুবক্তগীনের চেহারায় তার দৃষ্টি আটকে গেল। রাশভারী গলায় তিনি বললেন, এসব বালকদের সামলানো সহজ ব্যাপার নয়। তবে একে নিয়ে নাও। সুবক্তগীনের প্রতি অঙ্গুলি ইশারা করে বললেন তিনি। দাম মিটিয়ে সুবক্তগীনসহ আরো ক’টি বালককে টেনে নিয়ে এলো হাজীর লোকেরা।
ঘরে এসে সুবক্তগীনকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন হাজী নসর, তোমার কী নাম?
সুবক্তগীন।
তোমার মা-বাবা কি জীবিত?
জানি না। আমরা তাঁবুতে ঘুমিয়ে ছিলাম। ডাকাতরা তাঁবু আক্রমণ করল, আমি দৌড়ে পালাতে চাচ্ছিলাম, কিন্তু এক লোক আমাকে ধরে অনেক লোকের সাথে একত্র করে হাত-পা রশিতে বেঁধে ফেলল। এরপর এখানে নিয়ে এল। আব্দু-আম্মু কোথায় আমি জানি না।
তোমার আব্ব কি কাজ করত?
আমীরদের ঘরে কাজ করতো।
তুমি কাঁদছো না কেন?
এর উত্তর দেয়ার আগে আমি জানতে চাই, আপনার ধর্ম কি?
আমি মুসলমান। আমি হাজী। বললেন হাজী নসর।
তাহলে আমার নয় আপনার রোদন করা উচিত।
আপনার হজ অর্থহীন। আমাকে আব্ব বলেছিলেন, কুরআনের নির্দেশ হলো, কোন মানুষ কোন মানুষকে গোলাম বানাতে পারে না। আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করছেন, আমি কাঁদছি না কেন? আমি বুঝতে পারছি না এ অবস্থায় আমি কাঁদবো না হাসবো। আমার বয়স আপনার মতো হলে হয়তো এ কথার সঠিক জবাব আমি দিতে পারতাম।
হাজী নসর অবাক হয়ে গেলেন সুবক্তগীনের জবাব শুনে। এতটুকু বালকের মুখে এ ধরনের বিজ্ঞোচিত জবাব আর পাল্টা প্রশ্নের মুখোমুখি হবেন এমনটি তিনি কল্পনাও করেননি।
এ ধরনের কথা তোমাকে কে শিখিয়েছে?
আমার এক উস্তাদ আমাকে কুরআন-হাদীস পড়িয়েছেন। তিনি যে মসজিদের ইমাম ছিলেন, সেই ঠিকানা এবং বুখারায় পাঠানোর জন্যে লেখা তার চিঠির কথাও সে বলল। আরো বলল, তার বাবা নওশেরোয়ার বংশধর। সে তার বাবার মুখে ন্যায় ও ইনসাফের বহু কাহিনী শুনেছে। শুনেছে, তাদের পূর্ব পুরুষদের বহু কীর্তি-কাহিনী। এও বলল, আমার আম্মা প্রায়ই স্বপ্ন দেখতেন, তাকে শ্বেতশুভ্র এক দাড়িওয়ালা বুযুর্গ ব্যক্তি বললেন, তুমি এমন এক ছেলের জন্ম দেবে যে বড় হয়ে অন্যায় রোধ করবে, আর দুনিয়াতে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করবে। বুযুর্গ এ কথাও বলতেন, সেই ছেলে যদি আমি নাও হই তবে আমার বংশে এমন ছেলে অবশ্যই জন্ম নেবে।
তুমিও তোমার মায়ের স্বপ্নে বিশ্বাস কর?
মায়ের কথায় কিভাবে বিশ্বাস করব । গোলাম দাসীদের আবার আত্মবিশ্বাস ও ঈমান-আকীদা থাকে নাকি? আপনি কি আমাকে জানোয়ারের মতো মনে করে টাকার বিনিময়ে কিনে আনেন নি? যারা কেনা গোলাম তাদের নিজস্ব চিন্তা ও বিশ্বাসের কোন মূল্য আছে কি?
তোমরা যদিও আমার কেনা গোলাম, কিন্তু আমি তোমাদেরকে জীব-জন্তুর মতো রাখবো না। তোমাদেরকে আমি মানুষের মতো করেই গড়ে তুলব। হাজী নসর বললেন।
তুমি কোন কাজ জান?
আমাকে আব্দু-আম্মু বুখারায় নিয়ে আসছিলেন পড়ালেখার জন্যে। বলল সুবক্তগীন।
আমি তোমাদেরকে আমার ছেলেদের গৃহশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে দিচ্ছি।
তুমি তার সেবাযত্ন করবে, আর লেখাপড়া করতে চাইলে তাও করতে পারবে।
সুবক্তগীন রচিত ‘পান্দে নামা’ নামক একটি পুস্তক থেকে জানা যায়, সুবক্তগীন তিন বছরকাল হাজী নসর-এর বন্দী দশায় ছিলেন। কিন্তু সেখানে দৃশ্যত গোলাম হলেও তার জীবন গঠনে হাজী নসর-এর পৃষ্ঠপোষকতা ছিল কল্যাণকামী অভিভাবকের মত। হাজী নসর অধিকাংশ সময় সফরে কাটাতেন। ইতিহাস এ ব্যাপারে নীরব যে, প্রকৃতপক্ষে হাজী নসর কোন আমীর শাসক ছিলেন না, শুধু ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন। তবে একথা বোঝা যায়, হাজী নসর অন্যদের তুলনায় অনেকটা ন্যায়পরায়ণ ছিলেন।
সুবক্তগীন গৃহশিক্ষকের হাতে ন্যস্ত হলেও গৃহশিক্ষক প্রথমে তাকে গোলামের চেয়ে বেশি কিছু মনে করেন নি। কিন্তু প্রথম দিনেই সুবক্তগীন গৃহ শিক্ষককে বুঝিয়ে দিন, সে জন্মসূত্রে গোলাম নয়, ভাগ্য বিড়ম্বিত এক বালক। দুর্ভাগ্যক্রমে সে এখানে ভৃত্যে পরিণত হয়েছে।