রাত পোহালো । আহতদের যারা আড়ালে গিয়ে কোন মতে প্রাণ বাঁচাতে চেয়েছিল তাদেরও আর বাঁচার আশা রইল না। রক্ত আর লাশে একাকার। কোন সক্ষম পুরুষকেই ডাকাতরা প্রাণে বাঁচতে দেয়নি। যেসব মহিলা ও শিশু ওদের নির্দেশমতো দাসত্ব বরণে গড়িমসি করেছে, সময় ব্যয় না করে হিংস্র জানোয়ারগুলো তাদেরও হত্যা করেছে। সকাল বেলা আল-হাকামের স্ত্রী স্বামী-সন্তানের জন্যে পাগলের মত চিৎকার করে ময়দান জুড়ে খুঁজতে থাকে, কিন্তু সে প্রিয় সন্তানটিকে খুঁজে পেল না। স্বামীকে পেল, সেও আর জীবিত নয় মৃত। আল-হাকামের দেহ তরবারীর আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলেছিল ডাকাতেরা। তার সারাদেহ রক্তে ডুবে গিয়েছিল। বোঝা যাচ্ছিল, সে অনেক। লড়াই করেছে, ডাকাতদের উপযুপরি আক্রমণে তার মৃত্যু হয়েছে।
সুবক্তগীনের মা ময়দানের সব লাশ ওলট-পালট করে দেখছিল, আর যাকেই পাচ্ছিল বলছিল, তোমরা কি আমার মানিক সুবক্তগীনকে দেখেছ? ও খুব সুন্দর। কাফেলায় আমার ছেলের মতো এতো সুন্দর আর বাচ্চা ছিল না। লাশের পর লাশ ওলট-পালট করে স্বামীহারা স্ত্রী একমাত্র সন্তানের দেখা না পেয়ে পাগল হয়ে গেল।
বালিয়াড়ীর আড়ালে, ঝোঁপ ঝাড়ের ভেতর, টিলার চূড়ায় আর ময়দানে হাকামের স্ত্রী সন্তানের খোঁজে পাগলিনীর মতো দৌড়াচ্ছে। ডাকাতদের রেখে যাওয়া তাবু আর বিক্ষিপ্ত মাল-সামান ও প্রতিটি লাশকে বারবার ওলট-পালট করে দেখল, কিন্তু সুবক্তগীনকে পেল না। টিলায় চড়ে গলা চড়িয়ে ডাকল, সুবক্তগীন! বাবা, আমার কাছে আয়! বাবা সুবক্তগীন! আমার কোলে আয় । সুবক্তগীন! সুবক্তগীন! সুবক্তগীন!
লুটন্ত কাফেলার যারা বেঁচে ছিল, তারা সাক্ষাত মরণ থেকে রক্ষা পেয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত জীবনটা টেনে হেঁচড়ে কোন মতে লোকালয়ে ফিরে চলল। দেখতে দেখতে ময়দান জনশূন্য হয়ে গেল। শিয়াল, শকুন আর হিংস্র হায়েনাদের খোরাক হল মৃতদেহগুলো। আধমরা মানুষগুলোর ওপরও হুমড়ি খেয়ে পড়ল শেয়াল শকুনের দল। তখনও আল-হাকামের স্ত্রী ময়দান, বালিয়াড়ী ও ঝোঁপ ঝাড়ে তার সন্তানটিকে তালাশ করছিল। ডাকছিল– সুবক্তগীন! বাবা সুবক্তগীন। আমি এখানে, আয় বাবা সুবক্তগীন! আয় সুবক্তগীন!
বেশ কিছুদিন পর্যন্ত যতো কাফেলা, ডাকাতদল, সৈন্যবাহিনী এ পথে গিয়েছে একটি নারীকণ্ঠের আর্তনাদ আর সুবক্তগীন সুবক্তগীন ডাক তারা সকলেই শুনেছে। অনেকেই এই আওয়াজ নিয়ে নানা রূপকথার জন্ম দিয়েছে, আবার অনেকে এটাকে মনে করেছে কোন প্রেতাত্মার ডাক। দেখা গেলো, এই ডাকের ভয়ে এ পথে লোকের চলাফেরাই বন্ধ হয়ে গেছে। মানুষ প্রেতাত্মার ভয়ে এ পথ এড়িয়ে অন্য পথে গেছে। কেউ সাহস পাচ্ছে না এ পথে চলতে। যদিও সুবক্তগীনকে ডাকা কোন নারীকণ্ঠ এখন আর ঐ টিলা থেকে ভেসে আসছে না। তবুও টিলার দিকে ভয়ে কেউ তাকাচ্ছেও না। আল-হাকাম নিহত হয়েছে। যদি সে জীবিত থাকত তাহলে এই মুহূর্তে স্ত্রীকে টেনে হেঁচড়ে নিরাপদে কোথাও নিয়ে যেত আর বলতো, আমি যা বলেছিলাম তা বুঝতে চাইছিলে না যে, গরীবের ছেলে সত্যের পূজারী হয় না, পেট পূজারী হয়। তোমার কল্পনার শ্বেত-শুশ্রুধারী লোকের সেই ঘটনা বাস্তব নয় অলীক, কল্পনা, অবাস্তব স্বপ্ন। ভোগ-বিলাসিতা, ধন-সম্পদ, মিথ্যা আর প্রতারণার যেখানে দাপট সেখানে সত্য ও ন্যায়নীতির মৃত্যু ঘটতে বাধ্য। আজ জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিবেকের পরিবর্তে পাষণ্ড, বেঈমান-বদমায়েশরাই সুখ্যাতি পাচ্ছে। সুবক্তগীনের মা! কুরআনের ইঙ্গিত আমাদের মতো ভবঘুরের সন্তানের ভাগ্যে ফলে না। সাধ হোক আর আকাঙ্ক্ষা হোক, কল্পনা হোক আর বাস্তবই হোক। জনমানবহীন বিজন প্রান্তরে আল-হাকামের স্ত্রীর সুবক্তগীন, সুবক্তগীন আওয়াজ আর কেউ শুনল না। ইতিহাসের পাতা থেকে অন্ধকারে চলে গেল সুবক্তগীনের মায়ের অহাজারি ও কান্না।
ইসলাম মানুষকে দাসী-বদীতে রূপান্তরের ব্যাপারটি প্রায় বিলুপ্তির নিকট নিয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু খেলাফতে রাশেদার পর রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার আশ্রয়ে গোলাম-বাদীর বেচা-কেনা আবার জমে উঠল। বাদশাহ, শাহানশাহ ও সম্রাটরা ভোগ আহ্লাদে ডুবে গেল। মুসলিম শাসকদের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত, চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র বেড়ে গেল। রাজতন্ত্রের প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের কবলে খেলাফত ভেঙ্গে খান খান হল। নামে মাত্র একজন খলিফা রইল। প্রকৃত খেলাফতের কিছুই অবশিষ্ট রইল না। রাষ্ট্র পরিচালিত হতে লাগল আমীর উমারার ইচ্ছেমত। আমীর শ্রেণীর হেরেমগুলো গোলাম-বাদীতে ভরে গেল। আরাম-আয়েশ ভোগ-বিলাসিতার আয়োজনে শাসক শ্রেণীর মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল। দাস-দাসীরা পরিগণিত হলো আভিজাত্যের প্রতীকস্বরূপ।
বুখারার এক মাঠ লোকে লোকারণ্য। অসংখ্য মানুষের ভীড়। হাঁক ডাক হচ্ছে। ডাক উঠছে। মানুষের মেলা। বনি আদম কেনাবেচার হাট। দলবেঁধে ছেলে-মেয়ে, তরুণ-তরুণী ও মহিলাদের সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়েছে। নিলাম হচ্ছে কয়েকটি কাঠের মাচাং-এ। উপরে তাবু টানানো?। একটি মাচাং-এ কয়েকটি তরুণী। আনকোরা । ডাক উঠছে,…ইনটেক, কুমারী, সম্পূর্ণ অব্যবহৃত। সরাসরি ঘর থেকে নিয়ে আসা। উমদা তমাল দাম কম। মাত্র প্রতিটি একশ’ দিনার। কে আছে বল….একশ’ একশ’ একশ। দু’কিশোরীর কাঁধে হাত রেখে হাঁক ছাড়ল এক বিক্রেতা।