‘নীতি-নৈতিকতার কথা ওকে আমি বলেছি’- বলল আল হাকাম। আমার এলেম কালাম বেশি নেই। তবে আমি ন্যায়ের প্রতীক নওশেরোয়ার অধঃস্তন বংশধর। আমি বাপ-দাদা ও মুরব্বীদের কাছে যেসব ন্যায়নীতি ও ইনসাফের কথা শুনেছি, সে সব আমি ছেলেকে বলেছি। তাছাড়া বাড়িতে সারাক্ষণ ওকে কুরআন-কিতাব নিয়ে পড়তে দেখেছি। কিতাবাদি থেকেও সে আদর্শ বাণীগুলো রপ্ত করেছে।
“তুমি একে বুখারায় নিয়ে যাও! আমি একখানা চিঠি লিখে দিচ্ছি। ওখানে তোমার ভালো কর্মসংস্থানও হয়ে যেতে পারে। আর হ্যাঁ! একা যেয়ো না। ওই পথটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। পথে ডাকাত, লুটেরাদের খুবই উৎপাত। তোমার তেমন কোন সহায়-সম্পদ না থাকলেও তোমার স্ত্রীই বড় রত্ন। এমন যেন না হয় যে, এই বিদূষী মহিলাকে জীবনের জন্যে হারিয়ে ফেল। তাছাড়া এ ধরনের শিশু-কিশোররাও খুব বেশি অপহরণের শিকার হয়। কাজেই কোন বণিক দলের সঙ্গী হবে। কিছুদিন অপেক্ষা কর, বড় কোন কাফেলা ওই দিকে গেলে আমিই তোমাকে খবর দেব।” বললেন মসজিদের ইমাম।
ওই যুগে দূরের কোন সফরে ডাকাত-লুটেরাদের থেকে আত্মরক্ষার জন্যে দল বেঁধে লোকজন সফর করতো। এক দু’জনকে পেলেই ডাকাত-লুটেরা দল সর্বস্ব লুটে নিত। কখনও পুরো কাফেলা আক্রমণ করতো ডাকাতেরা। অস্ত্রের মুখে ছেলে-মেয়ে ও নারীদের অপহরণ করে গোলাম দাসী হিসেবে বাজারে বিক্রি করে দিত।
যাদের দায়িত্ব ছিল লুটেরা-ডাকাতদের আক্রমণ-অত্যাচার থেকে নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধান করা, সেসব আমীর-উমরারা ডাকাতদের কাছ থেকে সুন্দরী মেয়ে ও ছোট শিশুদের দাস-দাসী হিসেবে কিনে নিতো। এতে ডাকাত লুটেরারা উৎসাহ পেত। ইমাম সাহেবের আশঙ্কা ছিল যথার্থ। আল-হাকামের স্ত্রী যেমন ছিল সুন্দরী, তার ছেলে সুবক্তগীনের ছিল বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। তার চেয়েও বড় কথা, ইমাম সাহেব বুঝেছিলেন, এই ছেলের মা কোন সাধারণ যাযাবর মহিলা নয়, তার ভেতরে অবশ্যই অসাধারণ গুণ রয়েছে যা অন্য মহিলাদের নেই। ভালো মা ছাড়া এ ধরনের শিশু জন্ম নিতে পারে না। সুবক্তগীনের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই ইমাম সাহেব আল-হাকীমকে সতর্ক করেছিলেন। ইমাম সাহেব বুঝতে পেরেছিলেন, ওর বাবার চেয়ে ওর মায়ের অবদান বিশেষ গুরুত্ব রাখে এক্ষেত্রে।
স্থানীয় কোন কাফেলার যাত্রা-সংবাদ দীর্ঘ দিনেও পাওয়া গেল না। একদিন দেখা গেল, তিনশ’ জনের এক বিরাট কাফেলা নারী-শিশু ও বাণিজ্যিক পণ্য নিয়ে সমরকন্দ-বুখারার দিকে যাচ্ছে। কাফেলার অধিকাংশ লোক সওদাগর মনে হল। ছেলের ভবিষ্যতের দিকে খেয়াল করে আল-হাকাম সওদাগর কাফেলার সাথে মিলে অভিষ্ট লক্ষ্যে যাত্রা করল। সারা দিন বিরামহীন চলল কাফেলা। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে একটি ময়দানে কাফেলা যাত্রা বিরতি করল। তবু ফেলে রান্না-বান্না হল। ক্লান্ত-শ্রান্ত যাত্রীরা যে যার মতো গা এলিয়ে দিল ঘুমের কোলে। কয়েকজন তাবুর আশে-পাশে পাহারায় নিযুক্ত হল। তাদের হাতে তীর-ধনুক, ঢাল-তরবারী। তখন রাত প্রায় অর্ধেক পেরিয়ে গেছে। হঠাৎ প্রহরীদের কানে ভেসে এলো অশ্বখুরের আওয়াজ। সতর্ক প্রহরীরা ধনুকে তীর যোজনা করল। ক্রমেই আওয়াজ নিকটতর হচ্ছিলো। এক সময় মনে হলো, এক, বিশাল সৈন্যবাহিনী এই দিকে ধেয়ে আসছে, হয়তো কোন দিকে যুদ্ধ যাত্রা করেছে কোন সৈন্যদল। আগন্তুকদের সংখ্যাধিক্য আন্দাজ করে প্রহরীরা কাফেলার শক্ত-সামর্থ্য কয়েকজনকে জাগিয়ে দিল। অন্যেরা তখনও ঘুমে অচেতন। জাগিয়ে ভোলা ব্যক্তিদের মধ্যে আল-হাকামও ছিল। ভাবসাব দেখে প্রহরীরা নিশ্চিত হলো, আক্রমণ অবশ্যম্ভাবী। সৈন্যদল হলেও এরা বণিক কাফেলার মাল-সামিন হস্তগত করবে, আর ডাকাত হলে তো সবই লুটে নেবে। ওরা সংখ্যায় বহু। তাই তারা অশ্বারোহী দলের আক্রমণ আশঙ্কায় কাফেলার নিরাপত্তা নিয়ে ভীষণ চিন্তিত হলো।
দেখতে দেখতে এক বিশাল বাহিনী মশাল জ্বালিয়ে দ্রুত বেগে অগ্রসর হচ্ছে তাঁবুর দিকে। তাঁবুর পাশে এসেই ডাকাত দল মশালগুলোকে তাঁবুতে ধরিয়ে দিল। বীভৎস ডাক-চিৎকার শুরু করল। ডাকাতেরা ওদের ঘোড়াগুলোকে এভাবে বিক্ষিপ্ত হাঁকাতে শুরু করল যে, তাঁবুর লোকেরা ঘুম থেকে উঠে কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই ওদের ঘোড়ার পায়ে পিষ্ট হতে লাগল। মহিলা ও শিশুরা আর্তচিৎকার দিয়ে যে যেদিকে পারল দৌড়াতে লাগল। মহিলারা কোলের বাচ্চাকে বুকে চেপে পালাতে চেষ্টা করল। কিন্তু ডাকাতদের তীব্র আক্রমণে কারো পক্ষেই নিরাপদ স্থানে যাওয়া সম্ভব হলো না।
আল-হাকাম ঘটনার আকস্মিকতায় স্ত্রীকে বগলদাবা করে টেনে একটা ঝোঁপের আড়ালে নিতে চেষ্টা করছিল, কিন্তু কিছুদূর যাওয়ার পর মনে পড়ল, তাদের কলিজার টুকরো সুবক্তগীন তাদের সাথে নেই। স্ত্রী চিৎকার শুরু করল ছেলের জন্যে। আল-হাকাম ওকে অনেক কষ্টে বুঝাল যে, তুমি চেঁচালে ডাকাত তোমাকে নিয়ে যাবে। স্ত্রীকে আড়ালে রেখে নিরস্ত্র হাকাম বেরিয়ে পড়ল ছেলের খোঁজে। এদিকে তখন ডাকাত দল ঘোড়া থেকে নেমে দু’হাতে ধন-সম্পদ লুটে মেয়ে ও শিশুদের বেঁধে এক জায়গায় জড় করছে। কাফেলার লোকদের আর্তচিৎকার, মহিলাদের ক্রন্দনরোল আর শিশুদের আর্তনাদে ময়দানে কেয়ামত নেমে এসেছে। ডাকাতদের প্রতিরোধ করার সামর্থ্য তাদের নেই। তীব্র আক্রমণে প্রহরীদলের সবাই নিহত হয়েছে। নিহত হয়েছে প্রতিরোধকারীরাও। পুরো কাফেলা এখন ডাকাতদের কজায়। সব মাল-সামান, নারী-শিশু, উট, ঘোড়া ডাকাতরা নিয়ে চলে গেল।