“আমার হেফাযত আমিই করবো, তোমাকে কিছু করতে হবে না। তুমি কুরআন পড়তে জান, অর্থ বোঝ, এরপরও মুখে এমন কথা কিভাবে উচ্চারণ কর!” . স্ত্রীর জবাবে কোন কথা বলল না আল হাকাম। রাগে-ক্ষোভে, নিঃশব্দে ভাগ্যের মুণ্ডপাত করছিল আল হাকাম। ইসলাম ও আল্লাহ্র রহমত থেকে সে এখন নিরাশ।
চল ফিরে যাই।
কোথায়?
তোমাদের কবিলায়। হয়তো ওখানে, নয়তো আশেপাশেই পাওয়া যাবে তাদের। বলল হাকাম।
“ওখানে না গিয়ে বরং ঘোড়াওয়ালা মনিবের কাছেই চল। আমার শরীর বিক্রি করে তোমাকে কাড়ি কাড়ি টাকা এনে দেবো। তুমি আরাম বিছানায় শুয়ে শুয়ে খাবে আর আত্মপ্রসাদে মেতে থাকবে এই ভেবে, বউটা আমার সুযোগ্যই বটে! শুনি, কোন ধাতের পুরুষ তুমি? দেখো, আমি আমার ছেলেকে তোমার মতো কাপুরুষ হতে দেবো না।” ক্ষুব্ধ বাঘিনীর মতো ক্ষীপ্ত কণ্ঠে বলল স্ত্রী।
“আগে তোমার ছেলে বাঁচুক সেই দু’আ কর। তারপর না হয় শাহনশাহ বানাবে।” তিরস্কারের সুরে বলল আল হাকাম।
“আমার ছেলে বেঁচে থাকবে। দেখো, একদিন ইবরাহীমের মতো তোমাকে বলবে, আব্ব, আমি যে জ্ঞান লাভ করেছি তা তোমাকে দেওয়া হয়নি। তুমি আমার হেদায়েত মতো চলো, আমি তোমাকে কামিয়াবির পথ দেখাব।”
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এক ধরনের আদর্শিক লড়াই শুরু হয়ে গেল। পুরুষালী উদ্বেগ আর হতাশা হাকামকে কাবু করে ফেলেছিল। সেই সাথে স্ত্রীর মধ্যে বিরাজ করছিল নিজের স্বপ্নের প্রতি অবিচল আস্থা। স্বামীর বিরূপতায় ও স্বপ্ন পূরণের বিঘ্নতায় হতাশা তাকে বিব্রত করছিল, কিন্তু পূর্বাপর ঘটনা তাকে নিজের আত্মবিশ্বাসে আরো অবিচল করেছিল। ফলে দুজনের দুই মেরুকরণে লাগামহীন হয়ে পড়েছিল ভাষা। পরস্পর বিতর্কের মাঝে পথ চলছিল তারা। এক পর্যায়ে চুপ হয়ে গেল আল হাকাম।
সেই রাত থেকে আবার তারা যাযাবর জীবনে ফিরে আসে। ব্যতিক্রম এতটুকু যে, আগে তারা থাকতো লোকালয় থেকে দূরে আর এখন থাকে লোকালয়ে। শহরের উপকণ্ঠে এখানে সেখানে। শহরে এটা ওটা করে পানাহার যোগাতে আল হাকামের তেমন কোন বেগ পেতে হয় না। দিন কোনমতে চলে যায়।
দুই বছর এক শহরে থাকার পর আল হাকাম অন্য এক শহরে পাড়ি জমাল। স্ত্রী তার কাছে বায়না ধরল, এখন আর ভবঘুরের মতো এখানে ওখানে থাকা নয়, কোথাও স্থায়ী ডেরা ভোলো। ছেলেকে কোন মসজিদে পড়তে দিতে হবে, নয়তো ওরও আমাদের মতো এখানে ওখানে ঘুরে ঘুরে জীবন কাটাতে হবে।
বছর খানিক আগেই আল হাকাম ও তার স্ত্রী ছেলেকে কুরআন শরীফ পড়াতে শুরু করেছিল। মা লক্ষ্য করছিল, তার ছেলে অন্য যাযাবর শিশুদের চেয়ে ভিন্ন। সে অন্য শিশুদের থেকে আলাদা চরিত্রের। কেমন যেন গম্ভীর, ভাবুক, কথা বলে বুদ্ধিদীপ্ত। অন্য বাচ্চাদের মতো বাজে জিনিসের বায়না ধরে না, কোন জিনিসের জন্য জেদাজেদি করে না। মা এও লক্ষ্য করেছে, তার ছেলে পড়ালেখার প্রতি খুব মনোযোগী। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা তার পছন্দ।
এক পর্যায়ে মায়ের সে আশা পূর্ণ হল। আল হাকাম এখন মনস্থির করল, এখানে কিছুদিন থাকবে। ছেলেকে নিয়ে মসজিদের ইমাম সাহেবের নিকট গেলে ইমাম সাহেব ছেলেকে মক্তবে ভর্তি করে নিলেন। ছেলেকে ইমাম সাহেব ছাত্র হিসেবে গ্রহণ করায় আল হাকাম ও তার স্ত্রী ইমাম সাহেবের যথাসাধ্য সেবাযত্ন করতে লাগল।
প্রথম দিনের সবকে এ ইমাম সাহেব বুঝতে পারলেন, এই ছেলে অন্য দশটি ছেলের চেয়ে ভিন্ন। একেবারে প্রাথমিক স্তরের পড়া সে বাবা-মায়ের কাছেই শিখে ফেলেছিল। সাধারণত পাঁচ-ছয় বছরের শিশুদের যে ধরনের জ্ঞান থাকে এ ছেলের তার চেয়েও অনেক বেশি মেধা ও প্রজ্ঞা তিনি দেখতে পেলেন। তাকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে বসিয়ে দিলেন। সেখানেও সে অন্যদের তুলনায় এমন কৃতিত্ব দেখাল যে, ইমাম সাহেব ভাবলেন, এ বাচ্চা অসাধারণ, অনন্য। এখানে শিশু সুবক্তগীন প্রায় চার বছর লেখাপড়া করল।
সুবক্তগীনের বয়স এখন দশ-এগারো। এর মধ্যে সে কুরআন শরীফ তরজমা ও তফসীরসহ পড়ে ফেলেছে। বেশ কটি হাদীসের কিতাবও সে ইমাম সাহেবের বিশেষ তত্ত্বাবধানে এরই মধ্যে পড়েছে। সুবক্তগীনের জ্ঞান-পিপাসা উস্তাদের জ্ঞান পরিধিকেও ছাড়িয়ে যেতে চায়। উস্তাদের কাছে সে এমন এমন জটিল সমস্যা তুলে ধরে যেগুলোর সমাধানে উস্তাদেরও হিমশিম খেতে হয়। এমন এমন জ্ঞানগর্ভ প্রশ্ন করে যা তাকে পেরেশান করে তোলে। উস্তাদ বুঝতে পারলেন, এর জ্ঞান-পিপাসা মিটানোর জন্য একে নিজের কাছে না রেখে বড় জ্ঞানীর নিকট কিংবা বড় প্রতিষ্ঠানে পাঠানো দরকার। সুবক্তগীন একদিন উস্তাদকে প্রশ্ন করে, উস্তাদজী! আমল ছাড়া এম কি পূর্ণতা পায়? তরবারীর জোরে আল্লাহর রাসূল (স.)-এর পয়গামের প্রসার ঘটানো কি জায়েয? আমি যদি সারা দুনিয়াতে কুরআন-হাদীসের পয়গাম ছড়িয়ে দিতে চাই তবে এর পদ্ধতি কি হওয়া উচিত? ও এ ধরনের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হাজারো প্রশ্নের মুখোমুখি হতে লাগলেন সুবক্তগীনের স্ত্র উস্তাদ। শিষ্যের ভবিষ্যত নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। অনেক ভেবে-চিন্তে একদিন আল হাকামকে ডেকে তিনি বললেন, তুমি ছেলেকে বুখারা নিয়ে যাও। স্ত্র তিনি একজন বিজ্ঞ আলেমের ঠিকানা দিয়ে বললেন, তোমার ছেলের মধ্যে আমি এলেমের যে তৃষ্ণা দেখেছি, তা নিবারণ করতে না পারলে ও পাগল হয়ে যাবে। শুধু জ্ঞান-পিপাসাই নয় ওর মধ্যে আমি সুপ্ত যে বীরত্বের লক্ষণ দেখছি, ওকে যদি সমর বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় তবে এই ছেলে একদিন বিখ্যাত হবে। বর্তমানে চতুর্দিকে যুদ্ধ বিগ্রহ চলছে। মুসলমান রাজা-বাদশাহরা পারস্পরিক হানাহানিতে লিপ্ত রয়েছে। এর সুযোগে কাফের-বেঈমানেরা মুসলমানদের বিচ্ছিন্ন করে গোলামে পরিণত করছে। এই ছেলে এসব নিয়ে গভীর চিন্তা করে। সাধারণত গরীবের ঘরে এমন মন-মানসিকতার ছেলে-মেয়ে জন্ম নেয় না। বড় কিছুর আশা করাও গরীবের সন্তানের জন্য মানায় না। তবুও যদি ভাগ্য প্রসন্ন হয়, কোন সুযোগ পায় তবে এই ছেলে আল্লাহর জমিনে আল্লাহর শাসন কায়েম করে ক্ষান্ত হবে। মুশকিল হলো, ওর মধ্যে দারুণ নীতিবোধ কাজ করে। নীতি-আদর্শের উপর অটল থেকে জীবনে বড় কিছু করা বড়ই কঠিন, তবে নীতিবানের দ্বারাই বড় কিছু হওয়া সম্ভব। সুবক্তগীন এমন এমন নীতি-আদর্শের কথা বলে যা কখনও আমি তাকে বলিনি। হয়ত ওকে ওর জীবনে বহু ঝড়-তুফান মোকাবেলা করতে হবে।