সে স্বামীর সাথে যাবতীয় কথা শেষ করে তার সামনে খানা পরিবেশন। করল। ঠিক এ সময় ঝুপড়িতে এক অপরিচিতা মহিলা প্রবেশ করল। সে প্রবেশ করেই ঝুপড়ির দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলল, “তাড়াতাড়ি খানা শেষ করে ছেলে। এবং স্ত্রীকে নিয়ে এখনই শহর ছেড়ে পালিয়ে যাও, কোথাও দাঁড়াবে না।”
এই মহিলা ছিল আমীরের বিশেষ আস্থাভাজন দুই রক্ষিতার একজন। সে আমীরের চিৎকার শুনে খাস কামরায় প্রবেশ করে আল হাকামকে হত্যা ও তার স্ত্রীকে অপহরণের চক্রান্ত শুনে ফেলেছিল। সে আল হাকামের স্ত্রীকে এক ঝলক দেখেও ছিল। নিষ্পাপ এই মেয়েটির সম্ভ্রম ও তার নিরপরাধ স্বামী-সন্তানের জীবন বাঁচানোর সিদ্ধান্ত নিল সে। আরো একজনকে সাথে নিল। নিজেদের দুরন্ত স্বপ্নময় কৈশোরের কথা মনে পড়ল ওদের। তাদেরও স্বপ্ন ছিল বিয়ে করে স্বামী সংসার নিয়ে সুখের ঘর বাঁধবে। কিন্তু টাকার বিনিময়ে এই লম্পট আমীর তাদেরকে চার দেয়ালের ভেতর যৌনদাসীতে পরিণত করেছিল। নিজেদের রূপ-যৌবন ও তারুণ্যের বিনিময়ে ওরা ভোগ করছিল বিলাসী জীবন। বিলাস উপকরণ ও ভোগ্যপণ্যের অভাব নেই এখানে।
আমীরের হেরেমে ওরা দু’জন নিজেদের ধূর্তামি, চাতুরীপনা ও কূটকৌশলে আমীরের নষ্ট জগতকে আরো সমৃদ্ধ করেছিল। নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছিল আমীরের ঘনিষ্ঠজন ও আস্থাভাজনরূপে। নিজেদের ধর্মীয় জীবন ও নারীকে বিলিয়ে দিয়েছে এরা। হেরেমের চক্রান্ত আর কূটচালে ওব্রা সিদ্ধহস্ত। স্বয়ং আমীর ছিল ওদের হাতের পুতুল। কিন্তু নারীত্বের ঐশ্বরিক চেতনা আর স্বামীর সংসার নিয়ে সুখময় জীবনের স্বপ্নটা যে মাঝে মধ্যে তাদের কাদাত না তা নয়। মানুষের সহজাত পবিত্র সত্তাকে কখনো ছাইচাপা দিয়ে রাখা যায় না। ব্রা যখন দেখল, একটি নিরপরাধ যুবতী, দুগ্ধপোষ্য নিষ্পাপ সন্তান ও বিদেশ-বিভূঁইয়ে অসহায় গরীব এক সৎ পুরুষ এক লম্পট আমীরের লাম্পট্যের শিকারে খুন হতে চলছে, তখন তাদের মধ্যে নিজেদের স্বপ্নময় যৌবনকে পঙ্কিলতায় ডুবিয়ে দেয়ার প্রতিশোধের আগুন জ্বলে উঠল। কিন্তু প্রতিশোধের ব্যবস্থা করতে না পারলেও তারা দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হলো, এদের জীবন বাঁচাবেই।
আল্লাহ তায়ালা রহমতের ছায়া বিস্তার করে আল হাকামের স্ত্রীকে সকল কলঙ্ক থেকে পবিত্র রেখেছিলেন। হাজারো বিপদের পরও এই যাযাবর মেয়েটির চরিত্রে সামান্যতম পাপের আঁচড় পড়তে পারেনি। নিজেরা আকষ্ঠ পাপে ডুবে থেকেও এই দুমহিলাকে আল্লাহ্ তায়ালা আল হাকামের স্ত্রীর সম রক্ষায় উসিলা বানিয়ে দিলেন। হয়তো এটা ছিল আল হাকামের স্ত্রীর পবিত্রতার পুরস্কার।
“আমার পক্ষে বেশিক্ষণ এখানে থাকা সম্ভব নয়, আর এর চেয়ে বেশি কিছু বলাও সম্ভব নয়। তুমি এখান থেকে তাড়াতাড়ি পালিয়ে যাও, এটাই আমার প্রত্যাশা।” এই বলে মহিলা বেরিয়ে গেল।
ঘটনার আকস্মিকতায় বিস্ময়াবিষ্ট নেত্রে স্ত্রীর প্রতি তাকাল আল হাকাম। দিনের বেলায় আমীরের বাড়িতে যা ঘটেছিল স্বামীকে বলল হাকামের স্ত্রী। চিন্তায় পড়ে গেল হাকাম। কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। স্ত্রী তাকে তাড়া দিল, ওঠ! আগে এখান থেকে বেরিয়ে পড়ি। কিন্তু আল হাকামের মধ্যে পালানোর ভাড়া নেই। সে বলল, এই মেয়েলোকটি মনে হয় আমীর বাড়ির সেবিকা। কেন সে আমাদের এখনই চলে যেতে বলল। আমি আমীরের সাথে দেখা করব। কিন্তু স্ত্রী তাকে সাথে নিয়ে ঝুপড়ি ছেড়ে এক্ষুণি বেরিয়ে পড়তে জিদ ধরল। বলল, এখানে আর এক মুহূর্ত থাকাও নিরাপদ নয়।
যে ঘাতককে নির্দেশ করা হয়েছিল আল হাকামকে খুন আর স্ত্রীকে অপহরণ করতে তারা তখন মদের হাড়ি নিয়ে বেহিসেবে গিলছে। তাদের হাতে উন্নত হাতিয়ার। ছিন্নমূল এক হতদরিদ্রকে খুন করে তার স্ত্রীকে তুলে নিয়ে আসা এদের জন্যে মামুলী ব্যাপার। সন্ধ্যার আগেই তারা ঝুপড়িটা ভালো করে পরখ করে এসেছিল। কোন বাধা-বিপত্তি, আইন-কানুনের ভয় ছিল না তাদের। তারা এই ভেবে উৎফুল্ল ছিল, একটা পুরস্কার পাওয়ার সুযোগ হয়েছে।
ভারত অভিযান ৩০
এরা মদপান শেষ করে আল হাকামের ঝুপড়ির দিকে রওয়ানা হল। ঠাট্টা-বিদ্রূপ, আনন্দ-উল্লাস করে তারা আল হাকামের ঝুপড়ির কাছে গেল। ঝুপড়ির দরজা বন্ধ ছিল। একজন অপরজনকে বলল, তুমি মহিলাকে ধরে ফেলবে। আমি মরদটাকে সাইজ করবো।
বন্ধ দরজা ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। ঘরের ভেতরটা অন্ধকার। ওরা গর্জে উঠল। কে আছিস, বের হ! কিন্তু নিস্তব্ধ। ওদের হুংকার ওদের কানেই ধ্বনিত হলো। অন্ধকারে হাতড়ে খোঁজাখুজি করল, কোন মানুষজন পেলো না। বুপিড়ি ভুল হয়েছে ভেবে ওরা সেখান থেকে অন্য ঝুপড়ির খোঁজে বেরিয়ে গেল।
ততক্ষণে আল হাকাম স্ত্রী-সন্তান নিয়ে শহরের বাইরে চলে এসেছে।
“আমাদের জন্য আল্লাহর জমিনও বুঝি সংকীর্ণ হয়ে গেছে। হতাশ কণ্ঠে বলল আল হাকাম।
“অধৈর্য হয়ো না সুবক্তগীনের বাপ। তুমি আমার কথা বিশ্বাস কর আর না কর কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমরা এমন কোন পাপতো করিনি যে জন্যে আমাদের কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। আমার কোন সন্দেহ নেই যে, আমি সেই কাঙ্ক্ষিত সন্তানকেই ভূমিষ্ঠ করেছি যার ইশারা আমি পেয়েছিলাম।”
“তুমি একটি বদ্ধপাগল। তোমার জন্যেই আমাদের এই শাস্তি।” ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল আল হাকাম। “সম্পূর্ণ একটা ভ্রান্ত বিশ্বাসে লিপ্ত রয়েছ তুমি। বিরাট ওলী-বুযুর্গ জন্ম দিয়ে ফেলেছে, এই বিশ্বাস দেমাগ থেকে দূর না করলে তোমার কপালে দুর্ভোগ শেষ হবে না। কুরআন শরীফকে তাবীজ মনে করো না। তোমাকে বিয়ে করাটাই আমার ভুল হয়েছে। গরীবের বউ অসুন্দর হলেই শান্তিতে থাকা যায়। এখন আমি তোমাকে পাহারা দে না পেটের আহার যোগাব?”