দীর্ঘক্ষণ আলাপ সেড়ে নসর সুলতানার ঘর থেকে বেরিয়ে, শাহী হেকিমের কাছে গেল। হেকিম হুররাণীও বেশ বুড়া। সুলতানার শিখিয়ে দেওয়া কথা সেহেকিমের কাছে বলল। সুলতানা তাকে বলেছিল, হেকিমের আপত্তি থাকবে প্রচুর। তারপরও এ কুপ্রস্তাব শুনে হেকিমের আপাদমস্তক কেঁপে উঠল।
নসর বলল, আপনার সামনে দুটি রাস্তা খোলা। প্রথমত আজীবন কয়েদখানায় কাটাবেন। এমন শাস্তির সম্মুখীন হবেন, জোয়ানরাও যা সহ্য করতে পারে না। আমার যবান আপনার বিরুদ্ধে যা বলবে তা নির্মম সত্য হয়ে দেখা দেবে। দ্বিতীয়ত দুনিয়ায় জান্নাতের দেখা পাওয়া। এখন বলুন কোনটা পছন্দনীয় আপনার।
দুর্বল হুররাণী গেড়াকলে আটকে গেলেন। অশুভ পরিণতির কথা ভেবে তিনি এমন বিষ তৈরী করে দিলেন যার এক ঢোক সেবন করলেই কেচ্ছা খতম। ইতিহাস এই বিষের নাম দিয়েছে লিবিয়ান আল-মানুক। নসর তাকে বললনা, এ বিষ কার ইশারায় বানানো হলো।
***
আমীর আবদুর রহমানের স্ত্রী মোদাচ্ছেরা বয়স সুলতানার চেয়ে কিছু কম। তাকে মদ, নারী ও সঙ্গীত জগৎ থেকে মুক্তি দিতে এই স্ত্রীর হাত দিল সর্বাধিক। সন্ধ্যার দিকে জনৈক চাকরাণীর মাধ্যমে সংবাদ প্রেরণপূর্বক হুররাণী জানান, অসুস্থতার বাহানায় আমাকে ডেকে নেয়ার ব্যবস্থা করো। সন্ধ্যার পূর্বেই মোদাচ্ছেরা জনৈকা চাকরাণীর মাধ্যমে শাহী হেকিমের কাছে খবর পাঠালেন যে, আমার খুব পেটব্যথা করছে। জলদি আসুন। শাহী হেকিম এসে পড়লেন।
মালেকায়ে আলিয়াহ! আজ সে কথা মনে পড়ছে, সুলতানা আপনাকে প্রয়োগের জন্য এক সময় আমার কাছ থেকে বিষ সংগ্রহ করেছিল। আমি আপনাকে সেদিন হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, কোনো চাকরাণী শরবত দিলে আপনি তা গ্রহণ করবেন না, কেননা ওটা শরবত নয় বিষ।
হ্যা! হেকিম সাহেব! মনে আছে। শুধু তাই নয়, এজন্য আপনি মহল ছেড়ে চলে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আমি বাদ সেধেছিলাম। হতে পারে একদিন আমীরে স্পেনকেই আপনার হাতে বিষ প্রয়োগ করা হতে পারে-তখন আপনি এমন হুশিয়ার করবেন; বলেছিলাম সে কথাও। জানিনা সেদিন অমন কথা আমি কেন বলেছিলাম। ও হ্যাঁ! আপনি আমাকে আজ ওকথা কেন স্মরণ করালেন- বলুন তো। আর এ অভিনব পদ্ধতিতে আপনার সাক্ষাতের হেতু কি?
আপনি যেহেতু সহজ, সরল, নিষ্পাপ নারী, হয়ত সে কারণেই খোদাতায়ালা আপনার মুখ দিয়ে ও কথা বের করিয়েছিল। আমীরে স্পেনের সর্বাপেক্ষা প্রিয় গোলাম যাকে তিনি দরবারে বিরাট পদমর্যাদা দান করেছেন সে আমার থেকে বিষ নিয়ে গেছে আমীরে স্পেনের মুখে তুলে দিতে। বলে হুররাণী মোদাচ্ছেরার কাছে পুরো ঘটনা তুলে ধরলেন। আমার বাধ্যবাধকতা বুঝেছেন তো?
বুঝব না মানে! বলেন কি! নসর একথা বলেছে কি, সে কার কথায় এ বিষ নিচ্ছে? কেন এ মহান অন্যায় করতে যাচ্ছে?
না! তা বলেনি। আমার জিজ্ঞাসার পরও বলেনি। আপনি আমীরে স্পেনকে বলবেন, তিনি যেন নসরের হাত থেকে কিছু গ্রহণ না করেন। এবার আমায় এজাযত দিন। আমার জিম্মা আমি পালন করলাম।
***
বয়স, নানা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ সর্বোপরি সামুদ্রিক যুদ্ধ সফরে আমীর আবদুর রহমান খুবই ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে পড়েন। তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে। তিনি কোন না কোন ওষুধ সেবন করে যাচ্ছিলেন। একদিন তার বিশেষ খাদেম নসর এসে বলল, আমি আপনার ক্লান্তি দূর করতে শক্তিবর্ধক টনিক নিয়ে এসেছি। সেবন করতে করতেই দেখবেন হারানো যৌবন ফিরে এসেছে।
আবদুর রহমান মুচকি হেসে বললেন, তুমিও তো বেশ বুড়িয়ে গেছ নসর। বার্ধক্য জোয়ান করে এমন লোভনীয় ওষুধ আমার আগে তো তোমারই সেবন করা অতি জরুরী। আমি বহু দাওয়া সেবন করেছি। এ ওষুধটা তুমিই সেবন কর।
নসর অস্বীকৃতি জ্ঞাপনপূর্বক বললো, এ ওষুধ তো স্রেফ আপনার জন্য এনেহি। আমি না হয় পরে বানিয়ে খেলাম।
নসর। আবদুর রহমান শাহী দাপট নিয়ে বললেন, আমি তোমাকে এই ওষুধ খেতে নির্দেশ দিচ্ছি। আবদুর রহমান নয় স্পেন-আমীর তোমাকে সেবন করতে বলছেন। জলদি মুখে পুরে দাও।
নসরের চেহারায় বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠল। হুকুম তামিল করতে গিয়ে ওষুধ নিজের মুখে পুরে দিল। আমীরে স্পেন তাকে সটকে পড়তে বললেন। নসর বেরিয়ে গেল। দৌড়ে শাহী হেকিমের কাছে এসো, বললো, যে বিষ আমীরকে খাওয়াতে গিয়েছিলাম তা আমাকেই খাইয়ে দেয়া হয়েছে। খোদার দিকে চেয়ে আমাকে বিকল্প কিছু একটা দিন।
জলদি গিয়ে বকরীর দুধ পান করো শাহী হেকিম বললেন।
নসর পাগলের মত দৌড়ে বেরোল। বিষে তাকে ধরেছে সেই কখন। বকরীর দুধ তার আর খাওয়া হলো না। পথিমধ্যেই চিৎপটাং। সেই সাথে দেহ থেকে প্রাণপাখি উধাও।
আবদুর রহমান বিষ প্রয়োগ থেকে বেঁচে তো গেলেন এবং বিষ দাতাই বিষের শিকার হল। তথাপিও এতে তিনি নেহাৎ চোট পান। যাকে তিনি বিশাল পদমর্যাদা দান করেছেন, গোলাম থেকে দরবারের অফিসার বানিয়েছেন সেই কি না তাকে বিষ প্রয়োগ করতে পারে? এ আত্মজিজ্ঞাসা তাকে পীড়া দিতে দিতে সাত দিনের মধ্যেই নশ্বর দুনিয়া ত্যাগ করতে বাধ্য করল।
কিছুদিনের মধ্যেই নসরের মৃত্যু রহস্য উদঘাটিত হলো। জানা গেল, সুলতানার প্ররোচনায়ই নসর অনিচ্ছাকৃত মহাপাপ করতে গিয়ে জঘন্য মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েছে। আমীর আবদুর রহমানের মৃত্যুর পর তদীয় পুত্র মোহাম্মদ ক্ষমতারোহণ করেন এবং সুলতানা ও তার পুত্র আবদুল্লাহ ইতিহাসের নিঃসীম আঁধারে হারিয়ে যায়। (সমাপ্ত)