সুলতানা! সেই রং আমার এখনো স্মরণ আছে, আবদুর রহমানের চেহারায় সেদিন দেখেছিলাম যা। তিনি প্রহরীকে বললেন, ওদেরকে শাহী মেহমানখানায় নিয়ে যাও। গোসল করানোর পর ভাল কাপড় পরাও। সেনাপতি উবায়দুল্লাহকে সর্বশেষে ডেকে পাঠাও। দেখলাম বুড়ো আবদুর রহমানের চোখ দুটো বালবের মত জ্বলে উঠল। তিনি আমাকে বললেন, খোদা তায়ালা আমাকে এই দায়িত্ব সঁপেছেন। অতি অবশ্যই আমার দায়িত্ব আমি পালন করব। তার বার্ধক্যের ক্লান্তি কোথায় যে লুকালো।
***
সেনাপতি এলে আবদুর রহমান তাকে বললেন, আপনার প্রেরিত পুরুষ-নারীরা আমার এখানে এসেছিল। আমাদের ভাণ্ডারে নৌ-সরঞ্জামাদি অতটা নেই যতটা আছে নরম্যানদের, কিন্তু ওদেরকে আমি নাস্তানাবুদ করতে চাই। সেনাপতি বললেন, আমাদের নৌ বহরে বিশাল নৌকাও ছোট বজরা আছে এ দিয়ে আমরা লড়াই করতে পারব না। আমি হুকুম দিলে বিশাল জঙ্গী জাহাজ বানাতে পারি। ততদিনে আমাদের ফেীজ উপকূল প্রহরা দেবে। নরম্যান পানি দস্যু থেকে দেশ বাঁচাবে।
তড়া করে সৈন্য প্রেরণ করা ভাল। নরম্যানদের দুঃসাহসিকতা এতই বেড়ে গিয়েছিল যে, তারা বেত ও চামড়ার ছিপি নৌকায় করে স্পেন উপকূলে হামলা করার সাহস পেল। গোয়েদলকুইভারে ওদের সাথে সর্বপ্রথম লড়াই হয়। নৌ জাহাজ ওদেরই খুব শক্তিশালী ছিল বিধায় সেখান থেকে উড়ে আসা তীর বৃষ্টিতে আমাদের বাহিনী পিছটান দিতে বাধ্য হলো।
ততদিনে মুসলিম নৌ-জাহাজ তৈরী হয়ে গেছে এবং কিছু জাহাজ বিদেশ থেকেও কেনা গেল। আমীর আঃ রহমান এদের চিরতরে খতম করার আশংকা ব্যক্ত করেন। তার নিজস্ব তত্ত্ববধানে বিশাল নৌবহর গড়ে তোলা হলো। বড় জাহাজের সংখ্যা পনের এর পাশাপাশি ছোট জাহাজ পালতোলা নৌকার সংখ্যাও কম নয়। নৌ-সৈন্য মহড়াও চালাল মাসখানেক। সমুদ্র উপকূলে বিশাল টাওয়ার বানানো হলো। সেখানে তীরন্দায় বসানো হলো। সমুদ্রবক্ষে সন্দেহজনক জাহাজ দেখলে এরা খবর পাঠাত।
নরম্যান দস্যুরা পূর্ণশক্ষিতে সমুদ্রে নামল। আমীর আবদুর আঃ রহমান খবর পেয়ে নিজেই নেতৃত্ব হাতে নিলেন। নেমে পড়লেন নৌ-যুদ্ধে। দস্যুরা কোনদিন এমন প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়নি। এবার ওদের যুদ্ধ সুশিক্ষিত সুদক্ষ জঁদরেল আঃ রহমান বাহিনীর সাথে। ওদের নৌবহরে আগুন লেগে গেল আবদুর রহমানের নিক্ষিপ্ত অগ্নিবাণে। বড় ক্ষতি স্বীকার করে ওরা প্রাণ নিয়ে পালাল। এরপর কেবল নরম্যান নামটাই বাকী থাকল। এরপর উপকূলে হামলার সাহস করেনি ওরা কোনদিন।
***
যিরাবের কথা শুনতে শুনতে সুলতানা বিরক্ত। বার্ধক্যের রওয়াসওয়া রূপটুকুনকে পুঁজি করে সে নিজকে যুবতী সাজিয়ে যিরাবকে হাত করতে গিয়ে বিলক্ষণ বিপাকেই পড়ে গেল। যিরাব তাকে কল্পনার জগত থেকে বাস্তবতার জগতে নিয়ে এলো। যিরাব তাকে বললেন, এখন তোমার শান্তি নেই কোন কাজেও। তার একান্ত আগ্রহ আবদুল্লাহকে আমীর বানানো। তার ধারণা ছিল, যিরাব একাজে সহায়তা দেবে কিন্তু যিরা তার আশার গুড়ে কেবল বালিই ছিটিয়েছে।
নপুংসক বুড়ো! যিরাব চলে যাবার পর সে ঘৃণায় রাগ ঝাড়ে, শরীরের শক্তি লোপ পাওয়ায় কোনো নারীর অযোগ্য হবার পরই এখন নিজকে আল্লাহর ওলি সাজিয়েছে। এক্ষণে আমীরে স্পেনের হিতাকাঙ্ক্ষী ও মুরীদ হয়েছে। ওর চেয়ে আমার প্রভাব কম কিসে। প্রাসাদের সকলেই আমার মুঠোয়। যাকে দিয়ে যখন খুশী তখন বিদ্রোহ করাতে পারি। রাখো! এক একজনকে ধরব। প্রথমে তোমার পালা আবদুর রহমান, এরপর মোদাচ্ছেরা। অবশেষে যিরাব, তোমাকেও ছাড়ছি না।
তার শিরা-উপশিরায় খুশীর নহর এবং শয়তানী ও পাশবিকতা ফুটে উঠল। মাথার সাদা চুল, যিরাবের কথা ও উদাসীনতা তাকে কালনাগিনী বানাল। এক্ষণে পালা দংশনের। পালা ছোবলের। বিষে বিষে নীল আরক্তের।
ইতিহাস যেখানে আবদুর রহমান, যিরাব, সুলতানা, মোদাহেরীর নামোল্লেখ করেছে সেখানে এক গোলামেরও নামোচ্চারণ দেখা যায়। গোলামের নাম নসর। তার কিছু গুণে মুগ্ধ হয়ে আবদুর রহমান গোলামীত্ব ছেড়ে দরবারের উঁচু পদ দেন তাকে। সুলতানা আমীরে স্পেনের সামনে এর অকুণ্ঠ প্রশংসা করতেন। যৌবনে সুলতানার হাতে যেহেতু গোটা মহল ছিল সেহেতু সে, এই নসরকে হাতের পুতুল করে রাখত। সে তাকে ধন-সম্পদও দিত।
নসর যিরাবের বয়সী হলেও সে তখন সুলতানার আজ্ঞাবহ ছিল।
পরদিন সূর্যের আলেয়াতে সুলতানার ঘুম ভাংল। তৎক্ষণাৎ সে চাকরাণীর মাধ্যমে নসরকে ডেকে পাঠাল।
নসর এলে তাকে পালংকে বসাল। বলল তার সাথে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। বুড়ের আবেগে সুড়সুড়ি দিয়ে শেষ পর্যন্ত মনের কথাটি বলল। নিয়ে গেল তার কানের কাছে মুখ। নগরের চোখ-মুখ ফুলে বড় হয়ে গেল ঐ কথা শুনে।
এই গোনাহ আমার হাত দিয়ে করাবেন? নসর একথা শুনে বলল।
হ্যাঁ নসর। এ গোনাহ আমার হাতদ্বারা করাব। সে সব গোনাহর কথা মনে করে দেখো, যেগুলো করে আমার করুশায় বেঁচে গেছো তুমি। সেসব গোনাহর একটাও আগে ফাস করে দিলে বধ্যভূমি হবে তোমার ঠিকানা। জল্লাদ আমার ইশারায় চলে সে কথাও তোমার অজানা নয়। তুমি এ কাজ করলে আমার পুত্র স্পেনের আমীর হবে আর তোমার পুত্র হবে স্পেনের সেনাপতি।
জিঞ্জিরে আটকা পড়ে গেল নসর। সে জানত সুলতানা এক কালনাগিনীর নাম। হেন কাজ নেই যা সে করতে পারে না। এর পাশাপাশি তার ছেলের ভবিষ্যৎও উজ্জ্বল। সে মুচকি হেসে বলল, আমি করব না তো কে করবে এ কাজ।