মুদাচ্ছেরা? সুলতানা বললেন, স্পেনরাজ তোমায় বিবাহ করেছেন, তুমি তার স্ত্রী। তিনি তোমার প্রতিও দুর্বল। তুমি কি মনে কর কেবল তোমার প্রতিই তার সব ভালবাসা উৎসর্গিত?
তিনি কারো নন, বললেন মুদাচ্ছেরা, আমি তার একমাত্র স্ত্রী নই। অন্যের তুলনায় তিনি আমাকে অধিক পেয়ার করেন। এজন্যেই আমাকে বিয়ে করেছেন। এক্ষণে তুমি তার কাছে সর্বাপেক্ষা আকর্ষণীয় হলে……….
কিন্তু আমি তার সাথে বিবাহ বসব না। বিবাহ-বহির্ভূত পন্থায় তাঁর সান্নিধ্যে থাকবো। তোমাদেরকে বলছি, কোন অবস্থায় আমার প্রতি শক্ৰমনোভাবাপন্ন হবে না। পূর্বেই বলেছি আমি যেহেতু নারী, তাই কোন নারীকে আমার পদতলে নেব না।
তার নিকট সর্বাপেক্ষা প্রিয় আমি এর দ্বারা তোমরা এ ধারণা করে না যে, তাঁকে তোমাদের থেকে ছিনিয়ে নিয়েছি। কাজেই তোমরা মনমুকুর থেকে উদাসীনতা ও হীনতা মুছে ফেল।
ওই তিন রাণী সুলতানার কক্ষ থেকে এই চেতনা নিয়ে বের হল যে, সে না কোন রাণী, না কেবল স্পেন রাজ্যের একক অধিকারিণী বরং সে এদের সহমর্মী ও সহনশীল। কাজেই সকল ঘৃণা ও ক্ষোভ তার মন মীনার থেকে ধুয়ে ফেলল।
***
এটা বে-ইনসাফী, এটাও জুলুম যে, কাল পর্যন্ত যে আপনার দৃষ্টিতে সেরা ছিল-আজ আমার প্রেম আঁচলে বন্দী হয়ে তাকে ভুলে চলেছেন। সুলতানা বললেন আবদুর রহমানকে, আপনি স্রেফ পুরুষ নন-একজন বাদশাহও। সুতরাং আপনার হৃদয়টাও বাদশাহসুলত হওয়া চাই। কোন নারী অপর এক নারীর হৃদয়কে কাঁচপাত্রের টুকরো হতে দিতে নারাজ। আমি দু-তিন দিন পর জায়গীর যেতে চাই। কাজেই আপনি মোদাচ্ছেরা, জারিয়াহ ও শেফাকে সে দৃষ্টিতে দেখবেন যে দৃষ্টিতে আমাকে দেখে থাকেন। নতুবা ওদের হাহাকার আমাকে জ্বালিয়ে ছাই করে দেবে।
না, সুলতানা। আবদুর রহমান সমোহনী সুরে বললেন, দুতিন দিন তো দূরে থাক তোমাকে দুতিন মুহূর্তের জন্যও চোখের আড়াল হতে দেব না।
আপনি বাদশাহ বলে আপনাকে কামনা করি না। অঢেল মনি-মাণিক্যের লোভেও আপনি আমার প্রিয়পাত্র নন। একজন মানুষ হিসেবেই আপনাকে ভালবাসি। আমার সেই ভালবাসা ঠিক তখনই আহত হয় যখন আমি কোন নারীকে আমারই কারণে হাহাকার করতে দেখি। মাত্র তিন দিন রাজন!
তিনি আবেগতাড়িত আলাপ করে আবদুর রহমানকে এভাবে কাবু করলেন যেভাবে ধুরন্ধর সাপুড়ে তার বাঁশি দ্বারা বিষধর সাপকে নত করে। সুলতানা এভাবে প্রেম নিবেদন করলেন যেন আবদুর রহমানকে ছাড়া তার দুতিন মুহূর্তও চলে না।
সন্ধ্যার দিকে তিনি জায়গীরের উদ্দেশ্যে হেরেম ছাড়লেন। আবদুর রহমান তার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দেহরক্ষী দিলেন-রাতের বেলা যারা তাকে দুশমন থেকে রক্ষা করবে। দিলেন শাহী বাবুর্চিও এবং অসংখ্য চাকর-বাকরও। এলোগেইছ ছদ্মবেশী হয়ে হাজির হল। দেহরক্ষীদের কেউ তাকে সন্দেহও করার সুযোগ পেল না।
সুলতানা বললেন, আমি সর্বদিক দিয়ে কামিয়াব। জানতাম না এই লোকটা নারীদের প্রতি এতটা দুর্বল। নারীদের ঘ্রাণ পেলেই সে দুজাহানই ভুলে যায়।
দিমাগে নারীসুষমা প্রভাব ফেললে রক্তখেকো যুদ্ধাংদেহী অস্ত্রধারণ করার শক্তি হারিয়ে ফেলে। পক্ষান্তরে নারী যদি কোন কাপুরুষের পিঠ চাপড়ে বলে, আমি তোমার সম্ভম তো সে বীর পুরুষ হয়ে যায়। আমরা স্পেনের মুসলিম শাসকদের এভাবেই অকর্মা বানিয়ে ছাড়ব। বলল এলোগেইছ।
এলোগেইছ ছোট একটা বাক্স এনেছিল। সেটি খুলে সুলতানার সামনে রেখে বলল, নগণ্য এই উপঢৌকনটুকু ফ্রান্স সম্রাট তোমায় দিয়েছেন। প্রকৃত উপঢৌকন এখন তোমার অপেক্ষায়।
আমাকে আর কি করতে হবে? সুলতানা প্রশ্ন করেন।
যা করে চলেছ-তাই। আমি তোমাকে বলে যাব তুমি সে অনুযায়ী কর্ম-সাধন করে যেতে থাকবে।
ওই তিন নারীকে আমি হাতের মুঠোয় এনেছি। মহলে কারো সাথে আমার দুশমনি নেই। মহলে যিরাব নামের সংগীতজ্ঞ যার প্রতি স্পেনরাজ উৎসর্গিত-তার কথায় দরবার চলে। সে যা ইচ্ছে তাই করতে পারে, এমন কি করেও ছাড়ে। কুদরতের এক অলৌকিক সৃষ্টি এই লোক। তার মাঝে এমন কিছু শক্তি আছে যার বদৌলতে পাথরে ফসল ফলাতে পারে। শেনরাজ তার সামনে মক্তবের ছাত্রের মত। আমাকে সে কতকটা সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা শুরু করেছে। আমি তার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গবেষণা শুরু করেছি। আশা করি তাকেও কুপোকাত করতে খুব একটা বেগ পেতে হবে না।
ওকে তোমার সহকর্মী করে নাও। আর হ্যাঁ, মনে রেখ সুলতানা! স্পেনরাজকে হত্যা করা যাবে না। জীবিত আবদুর রহমানই আমাদের উপকারে বেশী আসবে মৃত আবদুর রহমান থেকে। তাকে ইন্দ্রিয়পরায়ণতা ও বিলাসিতায় গলা অবধি ডুবিয়ে রাখার দায়িত্ব তোমার, বাদবাকী কাজ আমাদের।
এলোগেইছ! আমার সম্পর্কে একটা কথা তোমাকে বলতে চাই। আমি কারো হাতের খেলনা কোনদিনও হইনি। খেলনা বানিয়েছি সকলকে। তুমি এখনও তোমার প্ল্যান-প্রোগ্রাম আমাকে জানাও নি। কি তোমার ষড়যন্ত্র যার ক্রীড়নক হিসেবে আমাকে ব্যবহার করছ? আমার ওপর কি তোমাদের ভরসা নেই? যদি বলি তোমরা নিজেদের স্বার্থোদ্ধারেই আমাকে ব্যবহার করছ-এটা বললে ভুল হবে কি? এই মনি-মাণিক্য দ্বারা আমাকে ক্রয় করতে যেও না এলোগেইছ।
আমি যদ্দুর শুনেছি ধীমান নারী ইশারা বুঝতে সক্ষম। আমি তোমাকে নির্বাচন করে ভুল করিনি। অদ্যাবধি কি বুঝলে না, কি আমাদের প্ল্যান ও ষড়যন্ত্র? মনে করে দেখ তো, প্রথম সাক্ষাতে যখন তুমি আমার ছদ্মবেশ আবিষ্কার করেছিলে, তখন আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম-কি তোমার ধর্ম আর ধর্মের প্রতি কেমন তোমার টান? তুমি উত্তর দিয়েছিলে, ধর্মের প্রতি আমার কোন আকর্ষণ নেই। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়াই কেবল তোমায় ধর্ম। রাণী হওয়া এর অন্যতম। বলেছিলাম, তোমাকে আমরা রাণী বানাবো, বেশ কিছুদিন তুমি আবদুর রহমানের রাণী হিসেবে থেকেছ। স্পেনে মুসলিম পতনের শুরু হতেই একটা প্রদেশ পেয়ে যাবে। ফ্রান্স সম্রাট নিজ হাতে তোমার আঁচলে বেঁধে দেবেন এর চাবি।