কাজেই আমার এক্ষণের আশা, তুমি বাকী জীবনটা নিঃসঙ্গ কাটাবে। সিংহশাবক আবদুর রহমানকে আর কটা দিন একাকী কাজ করতে দাও। আল্লাহ তাকে দীর্ঘজীবী করুন। মরার আগে তিনি জালিম শাহীর টুটি টিপে ধরুন। তিনি এমন লোকদের মেরে তক্তা বানান, খোদা ছাড়া যাদের কেউ মারতে পারবে না। কেউ না।
তুমি জানো সুলতানা! এ সেই আবদুর রহমান যার দরবারে দুশমন হামেশা দোস্তির পয়গাম নিয়ে এসেছে। বাইজেন্টাইনের মিখাইল এসেছিল। এসেছিল থিওফেলিস। এমন কি স্পেন সাম্রাজ্যের সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট দুশমনকে ফ্রান্স সম্রাট লুই তার পুত্রদের প্রাসাদ ষড়যন্ত্র থেকে পরিত্রাণ পেতে আব্দুর রহমানের শরণাপন্ন হয়েছিল। দূত পাঠিয়ে সে বলেছিল, স্পেনের বিদ্রোহে আমি আর কোনো প্রকার মদদ করব না, এর বিনিময়ে আপনি আমার দেশে হামলা করবেন না। এজন্য আপনি অর্থকড়ি দাবী করলে আপনার চাহিদামাফিক দেব। আবদুর রহমান এ প্রস্তাবের জবাবে কেবল এতটুকু বলেছিলেন যে, আমি কোনো বিনিময় চাই না। বিনিময় কেবল এতটুকু যে, তুমি আমার স্পেনের দিকে চোখ তুলে তাকাবে না। তাকালে সে চোখ আমি উপড়ে ফেলব। স্পেনের। কোনো বিদ্রোহী তোমার দেশে আশ্রয় নিলে ঘোড়ার পিঠে বেঁধে পাঠাবে।
সুলতানা! এ সেই আবদুর রহমান! সমুদ্রেও যার শাসন চলত। তুমি তোমার দুনিয়ার সামান্য এক নারী মাত্র। তোমার আজীবনের কোশেশ ছিল তিনি যেন খোদ ময়দানে নেমে তলোয়ার না চালান।
আমি যাকে আপন করে চাই সে ময়দানে না মরুক– এজন্য তাকে আমার ময়দানে যেতে না দেওয়া। সুলতানা বলল।
এ বয়সে মিথ্যা বলা পরিহার করলে আত্মিক প্রশান্তি পাবে তুমি। কেন স্পেনের দুশমনরা কি তোমায় এ কথা বলেনি যে,আবদুর রহমানকে যুদ্ধের ময়দান থেকে ফেরাও। কেননা তার সে যোগ্যতা রণাঙ্গনে। ওটা আর কারো নেই। এ ছাড়া আমীর কোন ফৌজের সাথে থাকলে তাদের মনোবল বৃদ্ধি পায়। কিন্তু তুমি তাকে রুখতে পারনি। মোদাচ্ছেরা কোরআনের আয়াত তেলাওয়াত করে তার তলোয়ারে ঠুক দিয়েছিলেন। তার হাতে তলোয়ার দিয়ে বলেছিলেন, যাও এ আমার মাথার মুকুট! আল্লাহ তোমার সহায় হোন।
শেষ পর্যন্ত আবদুর রহমানের পৌরুষটা জেগে উঠেছিল। নরম্যান- পানিদস্যুরা ভূ-মধ্য সাগরে ডাকাতি করত ও মুসাফিরদের বড় বড় জাহাজ লুঠন করত। এই ডাকাতরা ছিল জার্মানীর বাঁশিন্দা। সমুদ্রে শিকার না পেলে তারা উপকুলে উঠে আসত এবং লোকালয়ে লুটতরাজ করত। তারা স্কভতিউয়ায় ঘাঁটি গেড়েছিল। সমুদ্রের ওই দিকটা দিয়ে কোনো জাহাজই যেতে পারত না। আবদুর রহমান এদের শক্ত হাতে দমন করে শুধু স্পেন নয় গোটা ইউরোপের উপকার করেন।
ক বছর আগের ঘটনা। কাজে কাজে হাঁপিয়ে আবদুর রহমান তার খাস কামরায় শ্রান্ত-ক্লান্ত বসেছিলেন। তিনি আমাকে সেতারা নিয়ে ডেকে পাঠালেন। আমি গেলে তিনি মুচকি হেসে বললেন, যিরাব। ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে পড়েছি। বুড়িয়ে গেছিতো! শোনাও না কিছু। তার ফরমায়েশ পুরা করতে তখন গুনগুন করছিলাম। এমন সময় দারোয়ান এলো। বললো, সালার উবায়দুল্লাহ এসেছেন পর্যটক কিসিমের কিছু লোকজন নিয়ে। তাদের সাথে কিছু নারীও আছে।
আমি বলেছিলাম আমীর এ সময় কারো সাথে কথা বলবেন না। কিন্তু তিনি নড়ে চড়ে বসলেন। আমাকে বললেন, সেতারা বন্ধ। এরা মজলুম হলে ঘটনা স্বাভাবিক নয়। তিনলোক ভেতরে এলো। তাদের সাথে মাঝবয়সী এক মহিলাও ছিলেন। ছিল দুযুবতী। তাদের কাপড়-চোপড় ছেঁড়া ফাটা। নারীদের চোখে অবিরল ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। এরা মুসলিম ছিল না। সকলেই ফরাশের ওপর হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। সকলেই হাতজোড় করা।
আমীর আবদুর রহমান স্বাভাবিক অবস্থায় বসতে বললেন। প্রহরী ডেকে এদের খানাপিনার ব্যবস্থা করতে বললেন। তাদের সামনে ফল-পাকড়ার তূপ জমা করা হলো। পরে বলা হলো, তোমরা কি উদ্দেশ্যে এখানে। আধবুড়ো মহিলা গেছো ভাষায় বললো, আপনি কি আমাদেরকে ঐ সব হিংস্ৰদানবদের ওপর ছেড়ে রাখবেন? আমরা কি মানুষ নই? এক লোক কনুই দিয়ে খোঁচা মেরে বললো, সাবধান হয়ে কথা বলো, ইনি বাদশাহ। আমীর আবদুর রহমান গর্জে ওঠলেন। বললেন, আরো সাবধান হয়ে কথা বলে। এখানে কোনো বাদশাহ নেই। আমরা তোমাদের সাহায্য করতে চাই। বলো সেই হিস্ৰদানব গুলোর পরিচয় কি? মহিলা বললেন, ওরা জার্মানীর পানি। এদের নরম্যান বলা হয়। ওরা বসতি উজাড় করে দিচ্ছে। ফসলই আমাদের রুটি রুজির মাধ্যম। তারা যাবতীয় ফসল ও শস্য লুট করে নিয়ে যায়। সুন্দরী তরুণীদের ধরে নিয়ে যায় এবং সমুদ্র উপকূলে তাদের বিক্রী করে ফেলে। আমরা যাব কোথায়? ওদের জাহাজ উপকূলে নোঙর ফেললে আমাদের লোকজন বসতবাড়ী ছেড়ে পালায়। এরা আমার মেয়ে। ওদের নিয়ে আমি শংকিত। এতদিন বন-বাদাড়ে ছিলাম। হাড় কাঁপানো শীতেই আমার এক বাচ্চা মারা গেছে ইতোমধ্যে। আমার পাগল হবার উপক্রম। আমার স্বামীই আমাকে কর্ডোভায় নিয়ে এসেছেন। ক্ষুধা-দারিদ্র্য সয়ে আমরা এই দূর সুদুরে উপস্থিত হয়েছি। আপনার তরবারীর ডগা নরম্যান পানিদস্যুদের মোকাবেলায় ভোতা হয়ে থাকলে এই বাচ্চাদের আশ্রয় দিন। আমরা শুনেছি মুসলমানরা নারী জাতির ইজ্জত-আব্রুরক্ষায় প্রাণ বিসর্জন দিয়ে থাকে।