***
যিরাব। সুলতানা উদাস ও হতাশার সুরে বললো, তোমাকে বলেছিলাম সোনালী অতীতের সে সব কাহিনী শোনাতে যা আমার যৌবনকে চাঙ্গা করে তুলবে কিন্তু তুমি আমাকে প্রচণ্ডভাবে হতশে করেছ। সে সোরাহী উঁচিয়ে পেগ-এ মদ ঢালতে লাগল।
যিরাব সোরাহী ধরে টেবিলে রাখলেন। বললেন, সুলতানা জীবনের সাঁঝবেলাজে দাঁড়িয়ে আমারও মন চায় আমার সাথে কেউ ফেলে আসা দিনগুলোর বর্ণিল কাহিনী শোনাক, কিন্তু তোমার-আমার চাহিদার মাঝে বেশ ফারাক। তুমি বার্ধক্যে এসে জোয়ান হতে চাইছ। এজন্য মনোরম সুতি মন্থন করতে চাও। এটা এক ধরনের হীনমন্যতা, বাস্তবতা থেকে পলায়ন। আমি তা চাই না। বার্ধক্যকে সাদরে গ্রহণ করো সুলতানা।
তুমি ব্যর্থ জীবন কাটাচ্ছ। কাজেই তোমার স্বার্থপরতা ত্যাগ কর।
তুমি না বলেছিলে আমার সাথে তোমার অন্তরঙ্গ সম্পর্ক?
সেতো এখনো বলি। এখনো উপলব্ধি হয়, তুমি যদি আগুনে ঝাঁপ দিতে বল তাহলে দেব। কিন্তু শেষ রাতের এ নিরিবিলিতে সে কথা শুনে নাও, যা হয়ত আর কোনদিন শুনতে পাবে না।
মনে হচ্ছে তুমি পরিপক্ক মুসলমান হয়ে গেছে। সুলতানা হেসে বললো, আমীরে স্পেন বোধ হয় হালুয়াক্কটি তোমাকে একটু বাড়িয়ে দিয়েছেন।
আমীর আবদুর রহমানেরও বড় এনাম হচ্ছে তিনি আমায় মর্দে মুমিন বানিয়েছেন।
আমার বিশ্বাস ছিল তুমি কখনো মর্দে মুমিন হতে চেষ্টা করবে না। তোমাকে আমার গলার কারণ বলতে পার এটাও। আমি তোমাকে শরাব ও নারীত্বে ডুবিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম।
যিরাব স্রেফ সংগীতজ্ঞ ছিলো না তিনি সংগীতে নতুনত্ব আধুনিকতাও এনেছিলেন। তিনি ছিলেন বিজ্ঞতার প্রবাদপুরু, জ্ঞানবিদ্যার পিরামিড।
তিনি বললেন, হ্যাঁ সুলতানা! আমি আমীরে স্পেনকে বিলাসিতা ও নারীমোহে ডুবিয়ে রেখেছিলাম। আমার যৌবনের পাতাগুলো তোমার সামনেই ধূসর অতীতে চলে গেছে। আমার এক একটি গোনাহ তুমি সামনে পেশ করতে পার। ঘাবড়াব না এতটুকু। প্রত্যেকটি গোনাহর স্বীকৃতি দেব। বলব আমি তওবা করেছি, অনুতপ্ত হয়েছি। আজ আমি সে সব কথার স্মৃতিচারণ করব যা তুমি শুনতে চাও না…………হ্যাঁ সুলতানা। একটি গোনাহ যা আমি এখনো করে যাচ্ছি, এর থেকে আমি তওবা করব না। সেটা কি নিশ্চয়ই শুনতে চাইবে। সে তোমার ভালবাসা। এর থেকে আমার মুক্তি নেই।
প্রেম-ভালবাসাকে তুমি গোনাহ মনে কর? প্রশ্ন সুলতানার।
এটা নির্ভর করে কার প্রেম আর কিসের প্রেম, কি উদ্দেশ্যে প্রেম-এর ওপর। তোমার অজানা নয় আমাদেরটা কেমন। আমীর আবদুর রহমানও তোমাকে হেরেমের হীরা বানিয়েছেন, আমিও তোমাকে হীরা বানিয়েছি।
অন্য কোন কথা থাকলে বলো যিরাব!
নাগো সুলতানা। দুঃখিত মনে যিরাব বললেন, ফেলে আসা দিনগুলোর পাতা ওলটালে আমার দুঃখ বেড়ে যায় তখন যবান সংযত করে রাখতে পারি না। আমাকে বলতে দাও, তারপর না হয় তোমারটা বলো।
আমার কাছে এক্ষণে কথা স্রেফ একটাই বাকী। আমার পুত্র আবদুল্লাহ আবদুর রহমানের স্থলাভিষিক্ত হবে। রাজপ্রাসাদের প্রভাবশালী জনাচারেক আমলাকে ইতোমধ্যে আমার মতানুসারী করে ফেলেছি, এক্ষণে আমীরের মৃত্যুর প্রহর গুনছি। এখন তার মরা দরকার। বেটা মরেও না। তুমি কি আমার পুত্রের পক্ষে নও?
সময় আসতে দাও। আমীরে স্পেনের পঁয়তাল্লিশ পুত্র। এই পুত্রদের কিন্তু তার বিবাহিত স্ত্রীর গর্ভের আর কিছু দাসীদের। এর এক বেটা তোমার। আমীর আবদুর রহমান তাদের কারো একজনকে নির্ধারণ করবেন। তিনি জীবদ্দশায় এমনটা না করলে রাজপ্রাসাদে হট্টগোল বেঁধে যাবে। মোয়াল্লেদীনরা ব্যাপারটাকে লুফে নেবে। ফলে দেশের অপূরনীয় ক্ষতি হবে। আর হ্যাঁ,একথাও মনে রেখো সুলতানা। মোদারে যে প্রভাব মহলে আছে, তোমার তা নেই। তিনি চাইলে তোমাকে মহল থেকে বের করে দিতে পারেন।
সুলতানা ভাবনার অথৈ সাগরে ডুবে গেল।
তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে আমীরে স্পেনকে মর্দে মুমিন কে বানিয়েছে? তুমি তাছিল্য স্বরূপ বলেছিলে, সে আমি নইতো! হ্যাঁ, সুলতানা! আমি নই। মোদাচ্ছেরা-ই তাকে মর্দে মুমিন সিংহশাবক বানিয়েছেন। তিনি ইসলামের অতন্দ্র প্রহরী। আবদুর রহমানের শরীরের রক্তেও রয়েছে আত্মসমবোধের স্রোত। সুলতানা। আমীরে স্পেনকে সিংহশাবক করে স্পেনের শেকড় মজবুতই করা হয়েছে। তার শাসনামলের শুরুতে খ্রস্টানদের ষড়যন্ত্রে শেনের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। কেননা এই লোক তোমার মত ডানাকাটা পরীদের অচিনপুরিতে ডুবে গিয়েছিল। মনে নেই, তোমার সৌন্দর্য সুষমা আর সংগীতের সুর মূর্ঘনা তাকে কোন পর্যায়ে নামিয়েছিল?
প্রশাসক অযোগ্য, সতর্ক কিংবা বিলাসী যাই হোক না কেন, হোক না সে চাটুকারদের কথায় ওঠ-বসকারী, তার দৃষ্টিতে ঐসব লোকই আজ ভালো মনে হবে যারা তাদেরকে অযোগ্য-অথর্ব সাব্যস্ত না করে।
আমি এ কাজ করেছি। এ কাজ করেছ তুমিও। এ সুযোগেই খ্রীস্টানরা মুসলিম সাম্রাজ্যে বিদ্রোহ করার দুঃসাহস দেখাতে পেরেছে। মোয়াল্লেদিনরা আন্দোলন করেছে। খুনের দরিয়া বয়েছে। দুহাত ভরেছে কবি-সাহিত্যিকদের। মোটকথা স্পেন পরিণত হয়েছে দুশমনদের অভয়ারণ্যে। কিন্তু এ বিশাল ব্যক্তিটি শেষ পর্যন্ত শরাবের পেগ দেয়ালে ছুঁড়ে দিয়েছেন। সঙ্গীতের তারগুলো ছিঁড়ে ফেলেছেন, তোমার সৌন্দর্য সুষমা উপেক্ষা করেছেন। এ সবই হয়েছে জাতির দুর্দিনের কিছু কাণ্ডারীর ঘাম ঝরা মেহনতের বদৌলতে।